ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),যশোর প্রতিনিধি, রোববার ১৩ অক্টোবর ২০২৪ || আশ্বিন ২৮ ১৪৩১ :
একসময় হাটে হাটে পান বিক্রি ও লবণের ব্যবসা করতেন। এরপর স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এতেই হাতে পেয়ে যান ‘আলাদীনের চেরাগ’। রাজনীতিকে পুঁজি করে পরের সম্পদ দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি প্রকল্পে লুটপাট, ভুয়া প্রকল্প, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ১৫ বছরে দেশ-বিদেশে গড়ে তোলেন অঢেল সম্পদের পাহাড়।
Advertisement
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান যশোর-৪ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য ‘সাহা’ বংশের রণজিৎ কুমার ‘রায়’। সম্প্রতি তার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রণজিতের পৈত্রিক ভিটা যশোরের পাশর্^বর্তী ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সাহা যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা বাজারে হাটবারের দিন পান বিক্রি করতেন। পরে লবণের ব্যবসা শুরু করেন। রণজিৎ সাহা তার বাবার সঙ্গে হাটে আসতেন। পরে খাজুরা বাজারে তারা বসতি স্থাপন করেন। এ সময় রণজিৎ সাহা স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে তিনি বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী বিজয়ী হন। ওই সময় নির্বাচনী পোস্টারে তার নাম ছিল রণজিৎ কুমার সাহা। পরে ১৯৮৫ সালে বংশের পদবী ‘সাহা’ পরিবর্তন করে রণজিৎ কুমার রায় নামে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। পরে ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
এলাকাবাসী জানান, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি টিনশেডের আধাপাকা বাড়িতে বসবাস করতেন রণজিৎ কুমার। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই শুরু করেন নিয়োগ বাণিজ্য। তার সংসদীয় আসনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০০’র কাছাকাছি। এর মধ্যে ৫০টির সভাপতি ছিলেন রণজিৎ রায়, তার স্ত্রী নিয়তি রায় ও ছেলে রাজীব রায়। বাকিগুলোর দায়িত্বে ছিলেন তার পছন্দের লোক। এমপি থাকাকালে তার সময়ে নিয়োগ হয়েছে সহস্রাধিক। এসব নিয়োগে তিনি একেকজন প্রার্থী থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। আবার এক পদের জন্য ১০ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সর্বোচ্চ দাতাকে নিয়োগ দিয়ে বাকিদের টাকাও ফেরত না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগে এই অর্থবাণিজ্য করেছেন তিনি। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও সরকারিকরণের নামেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়েছেন। পুলিশে নিয়োগে বহুজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে হাতেগোনা কয়েকজনকে চাকরি দিয়েছেন। চাকরি না হওয়া প্রার্থীদের অধিকাংশই তাকে দেওয়াা টাকা ফেরত পাননি।
Advertisement
স্থানীয়দের অভিযোগ, টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও ঐচ্ছিক তহবিলের ৯০ ভাগ টাকা কাজ না করেই হজম করেছেন এমপি রণজিৎ। তার অবৈধ আয়ের আরেক মাধ্যম ছিল টেন্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পের কমিশন। শ্মশানের জমি কেনার নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলে ৭৭ শতক জমি নিজের নামে লিখে নেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নামে ১৫ বছরে বেশুমার অর্থবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক এনে দেওয়ার নাম করেও টাকা হাতিয়েছেন। ক্ষমতার জোরে দখল করেছেন বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি। নামমাত্র মূল্যে অন্যের জায়গা লিখে নিয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের জমি নিজের নামে লিখে নিয়ে জোরপূর্বক তাদের ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার নামে। পাশাপাশি বহু খাস জমি দখল করেছেন তিনি। এ ছাড়া ভুয়া প্রকল্প বানিয়েও টাকা তুলে হজম করেছেন। অবৈধ এসব কাজে তিনি নিজে এবং তার পক্ষে মধ্যস্থতা করতেন ছেলে রাজীব রায়, বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস শান্ত এবং শ্রমিক নেতা রবীন অধিকারী ব্যাচা।
রণজিৎ পরিবারের যত সম্পদ : যশোর শহরের রেল রোডে রণজিতের নামে একটি পাঁচতলা ও তার স্ত্রীর নামে অপর একটি তিনতলা বাড়ি, নিউমার্কেটে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্পে দুটি ফ্ল্যাট, বাঘারপাড়া উপজেলা শহরে দোতলা ও খাজুরায় চারতলা বাড়ি, লোহাপট্টিতে ৭ শতক জমির ওপর দোতলা বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে দারুস সালাম রোডে দুটি ফ্ল্যাট, দুই ছেলের নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ও সল্টলেকে দুটি বিলাসবহুল বাড়ি, বাঘারপাড়া ও চৌগাছায় ২২৫ একর জমি, খুলনা ও সাতক্ষীরায় শত একরের মাছের ঘের, এক কোটি টাকা দামের একটি পাজেরো জিপ, স্ত্রীর ৩০ লাখ টাকার প্রাইভেটকার, দুই ছেলের ৬০ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার, ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০টি কাভার্ডভ্যান। জনতা ব্যাংক জেস টাওয়ার শাখার লকারে ২০০ ভরি স্বর্ণ। এ ছাড়া বেনামে বহু সম্পদ রয়েছে তার।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় রণজিৎ রায়ের ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও স্ত্রীর ৭০ হাজার টাকার সম্পদের কথা উল্লেখ করা হয়। ২০২৪ সালের হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, তার ১৩৩ গুণ ও স্ত্রী নিয়তির ২৬৩ গুণ সম্পদ বেড়েছে। হলফনামার বাইরে রণজিৎ ও তার পরিবারের অনেক সম্পদ রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই সাবেক এই এমপি সপরিবারে আত্মগোপনে চলে যান। তার বিরুদ্ধে দুদকে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদক এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংস্থা সূত্র জানিয়েছে।
Advertisement
এ বিষয়ে কথা বলতে রণজিৎ কুমার রায় ও তার পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নম্বরে বার বার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। আত্মগোপনের পর থেকে তাদের সবার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
রণজিৎ কুমার রায়