ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,বিশেষ প্রতিনিধি ,রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭ ভাদ্র ১৪৩১ :
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। তার সামনে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা কথা বলতে ভয় পেতেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনের সময় অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ আসার পর থেকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে অনুসন্ধানে।
Advertisement
এবার জানা গেল, বেনজীর আহমেদকে পুঁজি করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও কোটিপতি হয়েছেন। তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের তালিকার বাইরেও বেনজীর আহমেদের আরও সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরও দুর্নীতির তথ্য আসছে। সাবেক পুলিশ প্রধানের এখন এমন সব স্থানে সম্পত্তি পাওয়া যাচ্ছে, তা সব দুর্নীতিকে হার মানছে। তার সম্পদের পরিমাণ দেখে পুলিশ কর্মকর্তারাও হতবাক হয়ে পড়ছেন।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দায়িত্বে থাকাকালে বেনজীর আহমেদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বক্তৃতায় প্রায়ই বলতেন পুলিশের কোনো সদস্য দুর্নীতি বা কোনো ধরনের অপরাধ করলে তার দায়ভার বাহিনী নেবে না। এখন তিনি যে ধরনের অপরাধ করেছেন তার দায়ভার কে নেবে? তবে তার দুর্নীতির বিষয়টি তাকেই বহন করতে হবে। পুলিশে প্রতিটি সদস্য লজ্জিত বিষয়টি নিয়ে। ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, তিনি (বেনজীর) ৪ মে সপরিবারে সিঙ্গাপুরে গেছেন তা সত্য। দুদিন আগে তিনি তুরস্ক গেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। গোপালগঞ্জ ও তার শ্বশুরবাড়ির দুই ব্যক্তি তুরস্কে আছেন। তারা একসময় পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাব সদর দপ্তরে ঠিকাদারির কাজ করতেন। তারা বেনজীর আহমেদকে ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছেন।
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বেনজীর আহমেদের দখলে থাকা বিপুল জমির সন্ধান মিলেছে। ওইসব জায়গায় তিনি রিসোর্ট ও খামার করার পরিকল্পনা করেছিলেন। জেলা পুলিশের কিছু সদস্য তাকে সহায়তা করলেও সিনিয়র অফিসারদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। আর তিনি এসব কর্মকাণ্ড করেছেন র্যাব মহাপরিচালক ও পুলিশ প্রধান থাকাকালে। ইতিমধ্যে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন নতুন জায়গার সন্ধান পাচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অন্তত দেড়শ একর জায়গার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগের ৩ নম্বর সিটে ২৫ একর লিজের জমি ক্রয় করেন বেনজীর। সেখানে মাছের প্রজেক্ট, গরুর খামার, ফলের বাগান ও রিসোর্টের কয়েকটি কক্ষ আছে। এর মধ্যে গরুর খামারে ৩৩টি গরু আছে। এবারের কোরবানির ঈদে গরুগুলো বিক্রি করার কথা ছিল। ওই জায়গার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকারও বেশি। এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের আর দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাছাড়া লামা উপজেলার সরই ডলুছড়ি মৌজার টংগো ঝিরিতে রয়েছে আরও অর্ধশত একরেরও বেশি জায়গা। তথ্য পেয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল ওই স্থান পরিদর্শন করেছেন।
ওই টিমের এক সদস্য জানান, সুয়ালকের মাঝেরপাড়ার চা অফিস থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে ২৫ একর জমি জুড়ে রয়েছে ‘নেচার হিল এগ্রো’ নামে গরু-মৎস্য খামার, সেগুনসহ বিভিন্ন ফল ও ফুলের বাগান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোতলা পাকা দালান। খামারটিতে কাজ করছেন ১০ জনের মতো শ্রমিক।
Advertisement
ডলুছড়ি মৌজার টংগো ঝিরিপাড়ার অজিত ত্রিপুরা বলেন, ‘মং ওয়াইচিং নামে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বেনজীর আহমেদের পক্ষে জোর করে ১ লাখ টাকা দিয়ে ৫৫ একর জায়গা দখলে নিয়েছেন। আমাদের মতো আরও অনেকের কাছ থেকে জায়গা নিয়েছে তারা। প্রতিবাদ করলেই লামা ও অন্য জায়গা থেকে পুলিশ এসে আমাদের হয়রানি করেছে। এতদিন ভয়ে এসব কথা কাউকে বলতে পারিনি।’
লামা উপজেলার সরই ডলুছড়ি টংগো ঝিরি বাগানের কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিম জানান, দীর্ঘদিন ধরে বেনজীর আহমেদের ৫৫ একর জায়গা দেখাশোনা করছেন। আগে মং ওয়াইচিং বেতন পরিশোধ করলেও পাঁচ মাস ধরে কোনো বেতন পরিশোধ না করায় অতিকষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে।
তবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং গোয়েন্দাদের জানান, পার্শ্ববর্তী জায়গা থাকার কারণে সুয়ালকের মাঝেরপাড়ায় বেনজীর আহমেদের ২৫ একর জায়গা দেখাশোনার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে। তবে লামার জায়গা-জমি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তার জানা নেই।
সুয়ালক ইউপি চেয়ারম্যান উ ক্য নু মারমা বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের সুয়ালক মৌজার মাঝেরপাড়ায় জায়গা আছে তা আমি জানি। জায়গাটি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেখাশোনা করেন। মাঝেমধ্যে একজন এসপিও এখানে আসেন। তবে তার নাম জানি না। জায়গাটি সবার কাছে এসপির জায়গা হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি বাগানটিতে জোত পারমিট করা হয়েছে।
অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেয় আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে। ইতিমধ্যে সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন বেনজীর আহমেদ। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। ওই সময় আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
Advertisement