ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,ঢাকা প্রতিনিধি ,রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭ ভাদ্র ১৪৩১ :
তাসনিম সারা প্রিয়া তাঁর ওপর হওয়া নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে হাসপাতালে থাকার সময়ের ছবি দেখানছবি: মানসুরা হোসাইন
তাসনিম সারা প্রিয়ার মুখের বাঁ পাশে একটা বড় কাটা দাগ দেখা যায়। তাঁর মাথার একটি জায়গায় আঘাতের চিহ্ন, সেখানে নতুন করে চুল গজিয়েছে।
তাসনিম বলছিলেন, গত ১০ এপ্রিল দুপুরবেলায় রাজধানীর উত্তরার বাসায় তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন করেন স্বামী মো. রনি।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাসনিম বলেন, ‘রনির হাতে বাইসাইকেলের চেইন প্যাঁচানো ছিল, তা দিয়ে আমার মাথা ও মুখে আঘাত করেন। ধারালো চাকু দিয়ে মুখের বাঁ পাশের কপাল থেকে ঠোঁটের নিচ পর্যন্ত কাটেন। গলা চেপে ধরেন। ড্রেসিং টেবিলের কাঠের টুল দিয়ে আঘাত করে চোয়াল ও নাক ভেঙে দেন। হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করেন।’
গত ২২ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় তাসনিম তাঁর স্বামী রনিসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। অপর দুই আসামি হলেন মো. আল আমিন ও ইউনুছ। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় যৌতুকের দাবিতে মারধর করে গুরুতর জখম করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
তাসনিম গত ১৩ আগস্ট রনির কাছে তালাকনামা পাঠিয়েছেন।
গত বুধবার তাসনিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর ওপর হওয়া নির্যাতনের পরের রক্তাক্ত কয়েকটি ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দেন। এরপর বিষয়টি আলোচনায় আসে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তাসনিমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তাসনিম বলেন, ১০ এপ্রিল উত্তরার বাসায় তাঁর স্বামী রনি তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছিলেন। সে সময় বাসায় থাকা তাসনিমের মা-বোনকেও মারধর করেন রনির সঙ্গে আসা লোকজন। ঘটনার একপর্যায়ে মা, বোন ও কাজের সাহায্যকারী চিৎকার শুরু করলে রনি অন্যদের নিয়ে বের হয়ে যান। ভাড়াটে ও বাড়ির মালিক এসে তাঁকে উদ্ধার করেন।
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথমে চিকিৎসা নেন বলে জানান তাসনিম। পরে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন। তিনি বলেন, এখনো চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তাঁর নাক ও চোয়ালে দুটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
তাসনিম বলেন, ‘ঘটনার পর চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু রনি আমাকে, আমার মা ও বোন, এমনকি আমার সাত বছর বয়সী মেয়েকে অ্যাসিড মারবেন, আমার মুখ আরও বিকৃত করে দেবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। প্রাণনাশেরও হুমকি দিচ্ছেন। আমি আমার ও পরিবারের নিরাপত্তা চাই। আমার দুই সন্তানকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তাই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।’
সেদিনের নির্যাতনের পর যে বাঁচবেন, তা চিন্তা করতে পারেননি তাসনিম। তিনি বলেন, ‘আমি সেদিন মরি নাই কেন, এটাও স্বামীর রাগের আরেকটি কারণ।’
রনি অ্যারাবিয়ান বোরকা কালেকশনের মালিক। তাসনিমের ভাষ্যমতে, এখানে লাইভ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজের সূত্রেই রনির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। তাঁরা ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর বিয়ে করেন। বিয়ের আগে তিনি জানতেন, রনির এক স্ত্রী আছে। তবে বিয়ের পর জানতে পারেন, রনির আরও এক স্ত্রী আছে।
তাসনিমের প্রথম বিয়ে হয়েছিল ২০১৪ সালে। ২০১৮ সালে তালাক হয়। এই ঘরে তাঁর এক মেয়ে আছে। তাসনিম বলেন, এই বিয়ে ও মেয়ের কথা জেনেই তাঁকে বিয়ে করেছিলেন রনি। বিয়ের পর প্রথম ঘরের মেয়ে তাঁর সঙ্গেই থাকত।
বিয়ে করার পর থেকেই অশান্তি শুরু হয় বলে উল্লেখ করেন তাসনিম। তিনি বলেন, রনি তাঁকে একা ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। বের হতে হলে স্বামীর ঠিক করা লোক সঙ্গে যেত। আগের ঘরের মেয়েকে সময় দিলে বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বললে রনি রাগারাগি করতেন। ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দেন। তাঁকে একেবার নজরবন্দী করে ফেলেন রনি। এ থেকেই মূলত সমস্যার শুরু।
তাসনিম বলেন, ‘স্বামী চাইতেন উঠতে বললে উঠতে হবে, আর বসতে বললে বসতে হবে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না।’
আগের স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়েছে উল্লেখ করে তাসনিম বলেন, ‘আগের ঘরের মেয়ে আমার সঙ্গেই থাকে। তাই মেয়ের বিভিন্ন প্রয়োজনে তার বাবার সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছিল। রনি এটি পছন্দ করতেন না। ফেসবুকের লাইভে গিয়ে এটাকে তিনি অনৈতিক সম্পর্ক বলে প্রচার করেছেন। এর বাইরেও বলেছেন, আমি নাকি অনেকগুলো বিয়ে করে কাবিনের টাকা নিয়ে চলে এসেছি। এগুলো মিথ্যা কথা।’
তাসনিম বলেন, রনি নিজের মুখে বলেছেন, তাঁর প্রথম স্ত্রী তাঁকে ব্যবসার জন্য তিন কোটি টাকা দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও টাকা দিয়েছেন। তিনিও (তাসনিম) যাতে তাঁর বাবার ফ্ল্যাট বিক্রি করে তাঁকে টাকা দেন। তিনি বাবার ফ্ল্যাট বিক্রি করে টাকা দিতে পারবেন না জানানোর পর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।
রনি-তাসনিমের এক মেয়ে। বয়স ১০ মাস। তাসনিম বলেন, তিনি একপর্যায়ে রনিকে জানিয়েছিলেন, সংসার করবেন না। তিনি তালাক দিতে চান। এটা রনি মেনে নিতে পারেননি।
লাইভে রনি যা বলেছেন
তাসনিমের ফেসবুক পোস্টের পর রনি লাইভে এসে নানা কথা বলেন। লাইভ ভিডিওর কথা এই প্রতিবেদক শোনেন। প্রতিবেদন করার জন্য রনির কথা লিপিবদ্ধ করেন। পরে অবশ্য লাইভ ভিডিওটি মুছে (ডিলিট) দেন রনি।
Advertisement
লাইভে রনি বলেছিলেন, ভালোবেসেই কর্মচারী তাসনিমকে বিয়ে করেছিলেন। তাসনিমের কাছে যৌতুক চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দুই স্ত্রী ও দুই স্ত্রীর ঘরের সাত সন্তানের কথা তাসনিম জানতেন। তবে তাসনিম এখন ফেসবুকে মিথ্যা কথা বলে মামলা দিয়ে তাঁকে ‘ভিলেন’ হিসেবে সবার সামনে পরিচিত করানোর চেষ্টা করছেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াকে প্রকাশ্যে এনেছেন তাসনিম। আইনিভাবেই তিনি জামিনে আছেন। মেয়ের সঙ্গেও তাঁকে দেখা করতে দিচ্ছেন না তাসনিম।
রনি লাইভে আরও বলেন, তাসনিম তাঁর আগের স্বামীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রাখায় তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তাসনিমের গায়ে হাত তোলা ভুল হয়েছে। তবে তিনি হাত তুলতে বাধ্য হয়েছেন।
হত্যা করতে চেয়েছিলেন বা হত্যার হুমকি দিচ্ছেন—তাসনিমের এমন অভিযোগের বিষয়ে রনি লাইভে বলেন, হত্যা করতে চাইলে সেদিনই (১০ এপ্রিল) করতে পারতেন। তিনি স্ত্রীকে মারধরের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী যে অন্যায় করেছেন, তার জন্যও তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন।
রনি লাইভে বলেন, স্ত্রী হচ্ছে আমানত। স্ত্রী পর্দা করবেন। ঘরে থাকবেন। সন্তান লালন-পালন করবেন। এসব বলাতেই অশান্তি হয়েছে। রনি মনে করেন, তিনি তাঁর স্ত্রীকে শাসন করতেই পারেন।
২৫ থেকে ৩০ ভরি সোনা, ঘরের আসবাবসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তাসনিম নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেন রনি। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তাসনিম।
তাসনিমের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলাম। তিনি গত ২৪ আগস্ট উত্তরা পশ্চিম থানা থেকে বদলি হয়ে গেছেন। গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা এপ্রিল মাসের। মামলা হয় মে মাসে। মামলার পর আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। ফলে আসামিকে ধরা সম্ভব হয়নি। এরপর দেশে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর এখন তো তিনি বদলি হয়ে গেছেন।
Advertisement
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু প্রথম আলোকে বলেন, কতটা নিষ্ঠুর আর হিংস্র হওয়া যায়, এ ঘটনা তারই প্রমাণ। এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। স্ত্রীকে অনেকে সম্পত্তি মনে করছেন। তাঁরা এ ধরনের কাজকে অপরাধ বলেই মনে করছেন না। ফলে আইন থাকলেও তাঁরা ভয় পাচ্ছেন না। সমাজ-রাষ্ট্রও এ ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। ঘটনা ঘটলে নারীর অপরাধ খুঁজতে থাকে। ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ (ভিকটিম ব্লেইমিং) চলতে থাকে। তরুণ ও যুবসমাজকে এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতন বন্ধে সোচ্চার হতে হবে।