আট মাস বয়সি ছেলে মুহিনের জন্য দুধ কিনতে বের হয়েছিলেন প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ। সেই যে গেলেন, ফিরলেন লাশ হয়ে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়েছিলেন শুভ। এ সময় রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে। সেখানকার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই মঙ্গলবার মৃত্যু হয় তার।
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) ,ঢাকা প্রতিনিধি ,রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭ ভাদ্র ১৪৩১ :
শুভর একমাত্র শিশুসন্তান মুহিনের এখনও বোঝার বয়স হয়নি তার বাবা আর কখনও তাকে কোলে নিয়ে আদর করবে না। ছোট্ট চোখ দুটি প্রতিনিয়ত খুঁজে চলছে বাবাকে। এদিকে সংসারে উপর্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর শুভর পরিবার।
Advertisement
কৃষক পরিবারের সন্তান প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকায় একটি লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি করতেন। শুভর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামে।
সরেজমিনে দেখা যায়, একসময়ের আনন্দ উচ্ছল পরিবারটি এখন শোকের সাগরে ডুবে আছে। কথা হয় শুভর বাবা আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়ির একটি পাচিল নির্মাণের জন্য ছেলেকে ফোন করেছিলেন। এরপর থেকে ছেলের ফোন বন্ধ পান তিনি। এশার নামাজের পর জানতে পারেন ছেলের মাথায় গুলি লেগেছে।
আবু সাঈদ বলেন, ‘ওইদিন শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বাড়িতে এলাম। সন্ধ্যার পর ছেলেকে ফোন দিলাম। বাড়িতে একটা পাচিল তৈরি করব। কিন্তু ঠিকমতো কথা হলো না। ফোনটি কেটে গেল। শুভর মা আমাকে বকা দিল। ছেলে অনেক ব্যস্ত থাকে, যখন-তখন ফোন করতে নিষেধ করল। এরপর আর ফোন দিইনি। এশার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আসার পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা থেকে ছেলের বউ ফোন দিয়ে বলেÑ ‘আব্বা আপনার ছেলের শরীরে গুলি লেগেছে।’
Advertisement
সেদিন ঢাকার মিরপুরে নিহত প্রকৌশলী শুভর বাসায় ছিল তার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিয়াম। তিনি জানান, ভাইয়ের সন্ধানে বাসা থেকে বের হয়ে একদল অস্ত্রধারীর মুখোমুখি হন। ভাইয়ের মুমূর্ষু অবস্থার কথা বলে সেখান থেকে ছাড়া পান। কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়েও ভাইয়ের হদিস পাচ্ছিলেন না। পরে পুলিশের সহযোগিতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে যান। এ সময় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে শাহরিয়ারের মাথায় অস্ত্রোপচার চলছিল। শনিবার দুপুরে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মারা যান শুভ।
ওই দিন রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় শাহরিয়ারের মরদেহ। পরদিন বুধবার সকালে তার দাফন হয়। হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদে বন্দুকের গুলিতে আহত, গুলির আঘাতে মাথার খুলি চুরমার ও মস্তিষ্কে ক্ষতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অসহায় বাবা-মা ও শুভর স্ত্রী। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মা চম্পা বেগম। কথা বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। নাতি মুহিনকে কোলে নিয়ে কেঁদে চলেছেন অনবরত।
Advertisement
শুভর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানাও নির্বাক। বললেন, কোলের ছেলেকে নিয়ে কী করব জানি না। ওর ভবিষ্যৎ, ওকে বড় করে তোলা, সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে।
শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মহিউল আলম সুজন বলেন, ‘ছেলেটি মেধাবী ছিল। তার আয়েই চলত পরিবারটি। শুভর ছোট ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তার পড়ার খরচও শুভ চালাত। এখন সবকিছুই সমস্যা হয়ে গেল। এ অবস্থায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সরকারকে অনুরোধ করছি।’
প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ। প্রবা ফটো