ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) , সাভার প্রতিনিধি, বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট ২০২৪, ৭ ভাদ্র ১৪৩১ :
মহাসড়কের ওপর পুলিশের এপিসি গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছে ন্যুব্জ এক তরুণকে। গাড়ি থেকে সড়কে পড়তেই দুই হাত দুই দিকে আর পা দুটি ভাঁজ হয়ে যায়। একটি পা আটকে যায় এপিসির চাকার সঙ্গে। তখনও জীবিত ওই তরুণ। শ্বাস নিতে দেখা যায় তাকে। গাড়িটি থেকে পুলিশের এক সদস্য নেমে হ্যাঁচকা টানে ওই তরুণকে সড়কের মাঝের দিকে ফেলে দেন। এরপর সড়ক বিভাজক পার করে তাকে ফেলা হয় সড়কের সার্ভিস লেনে। যেন মানুষ নয়, কোনো জড় বস্তু টানা হচ্ছে!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের এই নির্মমতার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। হতভাগ্য ওই তরুণের নাম শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন।
Advertisement
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই সাভারে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা। সেখানেই এমন ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার ভিডিও পরে নজর কাড়ে অনেকের। নির্মম ওই দৃশ্য স্তব্ধ করেছে, হতবাক করেছে সবাইকে। শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন ঢাকার মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এমআইএসটির ওসমানী হলের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। পরিবার থাকত সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়।
ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন জানান, ১৭ জুলাই সকালে এমআইএসটির হল থেকে বাসায় আসেন ইয়ামিন। ১৮ জুলাই বাবার সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তে যান ইয়ামিন। এরপর তাদের আর দেখা হয়নি। তাকে মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও ধরেননি। বেলা ৩টায় একজন ফোন করে ইয়ামিনের মাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে গিয়েই ইয়ামিনের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার। কী ঘটেছিল সেদিন: ১৮ জুলাই সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুরো এলাকা ছিল শান্ত-স্বাভাবিক। বেলা ১১টায় সাভারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
Advertisement
সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যও অবস্থান নেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ করে সেøাগান দিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। একই সময়ে ওই এলাকায় মাথায় হেলমেট পরে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী। তাদের হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, রাম-দা, এমনকি বেশ কয়েকজনের হাতে পিস্তল ও শটগান ছিল।
মহাসড়কে সেই নেভি ব্ল– রঙের এপিসি: বেলা ২টায় মহাসড়কে দেখা মেলে নেভি ব্ল– রঙের পুলিশের একটি এপিসি। মহাসড়কের মূল লেনে অবস্থান নিয়ে সেটি থেকে আন্দোলনকারীদের দিকে রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। বেলা আড়াইটায় এপিসিটি সাভার বাসস্ট্যান্ডের পুরোনো ওভারব্রিজের কাছাকাছি এলে শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন সড়ক বিভাজক টপকে ওই এপিসির ওপরে উঠে যান। ওই সময়ই বুকের বাঁ পাশে গুলি লাগলে এপিসির ওপরে ইয়ামিন পড়ে যান। এ সময় এপিসির ওপরের ঢাকনা বন্ধ করে দেয়া হয়। সূত্র বলছে, এপিসির ভেতরে মাঠপর্যায়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন।
যে দৃশ্য নির্মম, নিষ্ঠুর ও অমানবিকতার: ইয়ামিন এপিসির ওপরে লুটিয়ে পড়ার পর সেটি অবস্থান বদলে সাভারের রানা প্লাজা ও ভ্যাট অফিসের মাঝামাঝি এলাকায় আসে। তখন এপিসির ভেতর থেকে পুলিশের এক সদস্য বাঁ দিকের দরজা খুলে দেন। তখন আরেকজন পুলিশ সদস্য এপিসির ওপরের ঢাকনা খুলে ওপরে উঠে ইয়ামিনকে টেনে সড়কে ফেলে দেন। ওই সময়ও ইয়ামিন জীবিত ছিল। তাকে শ্বাস নিতে দেখা যায়। পরনে ছিল একটি নেভি ব্ল– কালারের ট্রাউজার এবং গায়ে অনেকটা খয়েরি রঙের জামা। এপিসি থেকে তাকে ফেলে দেয়া হলে তার দুই হাত দুই দিকে পড়ে আর একটি পা ভাঁজ হয়ে পড়ে। আরেক পা এপিসির বাঁ দিকের চাকার সঙ্গে আটকে যায়।
তখন এপিসি থেকে পুলিশের এক সদস্য নেমে ইয়ামিনের হাত ধরে টেনে তাকে সরিয়ে নেন মহাসড়কের মাঝের দিকে। এরপর আরও দুই পুলিশ সদস্য এপিসি থেকে নেমে তাকে মূল সড়ক থেকে টেনে সড়ক বিভাজকের কাছে নেন। এরপর টেনে তাকে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলে দেন।
ওই সময়ও সড়কের সার্ভিস লেনে থাকা পুলিশ সদস্যরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছিলেন। ইয়ামিনকে যখন ফেলা হয় তখনও নিচে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর, পিস্তল দিয়ে গুলি কর।’
লাশ পড়ে থাকে মহাসড়কে: পুলিশ সদস্যরা ইয়ামিনকে সার্ভিস লেনে ফেলে সেখান থেকে সরে যান। ওই সময় একটি টিয়ার শেল পড়ে তার পাশেই।
ওই সময় তাকে ওভাবে ফেলেই সবাই সেখান থেকে সরে যান। প্রায় এক ঘণ্টা পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইয়ামিনের বুকের বাঁ পাশে গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন দেখা যায় বলে জানান চিকিৎসকরা।
Advertisement
ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারও কাছে বিচার চাই না। জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি।’