শিল্পকলার সাবেক মহাপরিচালক লাকীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি), বিশেষ  প্রতিনিধি,সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০২৪, ৪ ভাদ্র ১৪৩১ : 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে নানা কারণেই আলোচনায় এসেছেন লিয়াকত আলী লাকী। সরকারি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করেছিল, তেমনি তিনি আলোচিত ছিলেন থিয়েটারকর্মীদের সংগঠন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনে সৃষ্ট জটিলতার জন্যও। ২০২২ সালে এই সংগঠন থেকে সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিক উল্লাহ সেলিমকে অব্যাহতি দেন।

Advertisement

এসব নিয়ে তখন কম জল ঘোলা হয়নি। বরং অভিনেতা কামাল বায়েজীদকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারশন ও শিল্পকলার সব ধরনের কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন বলেই অভিযোগ।

এবার পদত্যাগী মহাপরিচালক লাকীর বিরুদ্ধে ওঠা সব রকম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তদন্ত করে তাঁকে বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন বিক্ষুব্ধ থিয়েটার কর্মীরা।

এসব বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদের সঙ্গে কথা হলে তিনি তুলে ধরলেন লাকীর সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের শুরুটা কীভাবে?

কামাল বায়েজীদকামাল বায়েজীদ। ছবি: সংগৃহীত

ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে কামাল বায়েজীদ বললেন, ‘লাকী সাহেবের সঙ্গে যেটা হয়েছিল যে, আমরা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে একটা স্বকীয় মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বটা কোথায়? গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনবারের বেশি কেউ একই পদে থাকতে পারেন না। তখন তিনি যখন চতুর্থবার নির্বাচিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করলেন, সেখানে আমি বাধা দিয়েছি। বলেছি, এটা অনৈতিক ও অগঠনতান্ত্রিক হবে। পাশাপাশি যখন দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারি বিভিন্ন জায়গা থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আসছে, তখন তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যান। তাকে বলেছিলাম, ফেডারেশন থেকে কয়েকদিন অব্যাহতি নিয়ে থাকেন, তাহলে আমরা কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারব। কারণ কারও ব্যক্তিগত দুর্নীতির দায় ফেডারেশন বহন করবে না। তৃতীয়ত, কোভিডের সময় যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাধারণ সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে অর্থের সংগ্রহ করেছেন, সেই অর্থের হিসাব তিনি কখনও দেননি বা অর্থ কী করেছেন সেটাও আমরা জানি না। আমি তার হিসাব জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্যাডে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তাতে আমার কোনো স্বাক্ষর ছিল না।’

মূলত এই তিন কারণে কামাল বায়েজীদের ওপর বিরাগভাজন হয়েছিলেন লিয়াকত আলী লাকী—অভিযোগ এমনটাই।

সাবেক এই সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য, ‘এসব কারণে বিরাগভাজন হয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে আমার বিরুদ্ধে কল্পনাপ্রসূত কিছু অভিযোগ উত্থাপন করেন। যাই হোক, সেসব অভিযোগ তখন আমি খন্ডিয়েছি। কিন্তু তিনি যেহেতু বিশাল ক্ষমতাধর মানুষ এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় তার যোগাযোগ রয়েছে, তাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে এগুলো করেছেন। অবৈধভাবে আমাকে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করেছেন।’

অভিযোগ তুলে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু সবসময় সোচ্চার ছিলাম যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে দুর্নীতিমুক্ত করা হউক। স্বজনপ্রীতিমুক্ত করা হউক। শিল্পকলায় শুধু সৃজনশীল কাজগুলো হবে, শিল্পকলা কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি না। আমি শিল্পকলা একাডেমির পরিষদ মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও তিনি এই কাজগুলো করেননি। আমরা পরিষদ থেকে বিভিন্ন সময়ে তার এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছি, কিন্তু কোনোটিই কার্যকরী হয়নি। বরং তিনি ক্ষমতাবলে রয়ে গেছেন। আইনকানুন মানেননি। আমরা গত বহুবছর যাবৎ তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সেসময় আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেননি।’

লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে বলে দাবি করেছেন কামাল বায়েজীদ। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি এখন পদত্যাগ করেছেন, সেটা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে সুস্পষ্ট, প্রমাণসাপেক্ষ অভিযোগগুলো রয়েছে, সেসবের জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে।’

Advertisement

পাশাপাশি দেশে সাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টি, মুষ্টিমেয় অনুগতদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের কথা জানালেন কামাল বায়েজীদ। তিনি বলেন, ‘সারাদেশে শিল্পকলা একাডেমির যে জীর্ণ দশা, শিল্পকলা একাডেমির শিল্পকলা ও সার্বিক উন্নয়নে তিনি তেমন কিছুই করেননি। শুধু নিজের পকেট ভারি করেছেন এবং অনুগতদের বিভিন্ন রকমের সুবিধা দিয়েছেন, যা অনৈতিক। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো যে, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি করেছেন। সহযাত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করেছেন তিনি। যাকে ব্যক্তিগতভাবে মনঃপুত হয়েছে তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন, বাকিদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এই যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছেন, সেই অভিযোগগুলো এখনও রয়ে গেছে। আমরা চাই, শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশে সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চায় একটি নিরপেক্ষ, নির্ঝঞ্জাট ও সৃজনশীল কাজ করবে।’

লাকীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশে থিয়েটারকর্মীরালাকীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশে থিয়েটারকর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে, সোমবার (১২ আগস্ট) এক সমাবেশে লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে ওঠা সব রকম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তদন্তসহ ৭টি দাবি জানিয়েছে বিক্ষুব্ধ থিয়েটার কর্মীগণ।

সেই ৭ দফা দাবিগুলো হলো—
১. লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে ওঠা সব দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম আর দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তদন্ত করে তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

২. শিল্পকলা একাডেমির অন্য যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম আর দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. লিয়াকত আলী লাকীকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

৪. গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও পথনাটক পরিষদকে মৌলিক রূপান্তরের পথে যেতে হবে। সব লোভ, ক্ষমতা আর স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থিয়েটারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৫. গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বদলাতে হবে। যেন তা স্বৈরাচারীর বশংবদ হয়ে না পড়ে, সে জন্য গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।

৬. জুলাই হত্যাকাণ্ডে আদেশ দেওয়া, নিপীড়নে অংশ নেওয়া, হত্যায় সমর্থন তৈরির পিআর করা মানুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যাঁরা কেবল সমর্থন দিয়েছেন হত্যাকাণ্ডকে, তাঁদের যে যে মাধ্যমে সমর্থন দিয়েছেন, সেই মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।

Advertisement

৭. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে লেজুড়বৃত্তি নয়, সর্বজনের সর্বপ্রাণের শিল্পচর্চার দিকে যেতে হবে।