লুই কানের নকশা পেতে আর মাত্র দুই মাস

SHARE

  parliament20160626144453ঢাকা: অবশেষে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের মূল নকশার সন্ধান মিলেছে। নকশাগুলো আনা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দুই  মাস পরেই দেশে আসছে নকশাগুলো। আর নকশা  হাতে পেলেই অপ্রয়োজনীয় সকল স্থাপনা সরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে সংসদ সচিবালয়। ফলে সরে যেতে পারে জিয়াউর রহমানের কবরসহ অন্যান্য কবর।

গত ৬ জুন লুই আই কানের নকশা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র যায় ৫ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল।  প্রতিনিধি দলে ছিলেন- জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব (আপিএ) আ. ই. ম গোলাম কিবরিয়া, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (উন্নয়ন শাখা-৯, অধিশাখা) মো. মনিরুজ্জামান, গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব, স্থাপত্য অধিদপ্তরের সহকারী স্থপতি সাইকা বিনতে আলম। প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৬  জুন সকালে দেশে এসে পৌছায়।

প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটি গিয়ে নকশাগুলো শনাক্ত করে আসে। এখন একটি প্রতিনিধি দল অথবা যে কেউ একজন গেলেই নকশাগুলো আনা সম্ভব হবে। নকশা আনা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ থেকে নকশাগুলোর প্রিন্টিং শুরু হয়ে গেছে।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভে ৮ হাজার নকশা রয়েছে বলে বাংলাদেশের স্থাপত্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। এরমধ্যে ৮৫৩টি নকশার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।  এই ৮৫৩টি নকশাই সংগ্রহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া আরও ৫৬টি  ডকুমেন্ট রয়েছে, যেগুলোও আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। লুই আই কানের প্রতি নকশার জন্য খরচ হচ্ছে ১৯ ডলার।

প্রতিনিধি দলের প্রধান জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব আ. ই. ম গোলাম কিবরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নকশাগুলো দেখে এসেছি। ঠিক করে দিয়ে এসেছি। ইতোমধ্যে প্রিন্টিং শুরু হয়ে গেছে। দ্রুতই সব নকশা আনা সম্ভব হবে।

স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বাংলানিউজকে বলেন, নকশা চিহ্নিত করা হয়েছে, এখন আনতে আর সমস্যা নেই। নকশার কপি হাতে পেতে আরও দুইমাস অপেক্ষা করতে হবে।

সংসদ ভবনের নকশা সংগ্রহের বিষয়টি অনুধাবন করে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই আই কান এর মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লুই আই কান এর মূল নকশা আনার নির্দেশনা দেন। কেননা মূল নকশা হাতে না থাকায় সচিবালয় সেগুনবাগিচা হতে আগারগাঁও এ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। তাই অনুলিপি ধরে নয়, ১৯৭৪ সালের মূল নকশা ধরে সচিবালয়সহ সব কিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

১৯৭৪ সালে শেরেবাংলানগরে ৪২ একর জায়গায় জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের জন্য সরকার ও মার্কিন কোম্পানি ডেভিড উইসডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তর কিছুটা সংশোধন করেছে।

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সংসদ ভবন এলাকার ভেতরেই গড়ে তোলেন মাজার ও কবরস্থান। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মধ্যিখানে  বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় জিয়ার মাজার কমপ্লেক্স। আর জিয়া ও এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউ এর পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে আরো অন্তত সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।

লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রোলপাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ করা হয়।

জাতীয় সংসদের ইতিকথা
১৯৬১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই ভবনের স্থপতি নিয়োগ করা হয়। তার প্রস্তাবেই লুই আই কান এই প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দীর্ঘ সাধনার পর ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।