ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪, ৩১ আষাঢ় ১৪৩১ : প্রশ্নফাঁস চক্রে অভিযুক্ত গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীরও গুরু রয়েছেন। সেই গুরু যে প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলহোতা হবেন- এ নিয়ে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। এই ব্যক্তি হলেন- সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক সদস্য দুর্নীতির দায়ে দণ্ড পাওয়া অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান।
Advertisement
দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশের কুখ্যাত নাম ‘হাওয়া ভবন’-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন মাহফুজুর। আর তার গাড়িচালক হিসেবে বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁস চক্রের আরেক হোতা হিসেবে আবির্ভূত হন আবেদ আলী।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরই প্রশ্নফাঁস চক্রের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন মাহফুজ। আর এর ব্যাপকতা পায় ২৪ বিসিএসে। হাওয়া ভবনের প্রেসক্রিপশনে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রশ্ন বাণিজ্য গড়ে তোলেন এই মাহফুজ।
সেই টাকার ভাগ পেতেন তখনকার শীর্ষ রাজনীতিকরা। হাওয়া ভবনে বসে সেই টাকার ভাগ বাটোয়ারা হতো। আর সেখানেই ঠিক করা হতো কারা চাকরি পাবেন, আর কারা পাবেন না। এরপর তালিকা চলে যেত পিএসপিতে সেই অনুযায়ীই হতো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে ঢুকে যেতেন হাওয়া ভবনের তালিকাভুক্তরা।
ওয়ান ইলেভেনে অর্থাৎ ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক অভিযানে ধরা খান মাহফুজ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রকাশিত প্রথম ৫০ জন সন্দেহভাজন ‘দুর্নীতিবাজের’ তালিকায় নাম আসে তারা।
তার বিরুদ্ধে বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় ঘুষ গ্রহণসহ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি অর্জনের মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হওয়া মামলায় ২০০৯ সালে মাহফুজকে ১৩ বছরের সাজা দেয় ঢাকার ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালত। এরপর আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সম্প্রতি আবেদ আলীকে গ্রেপ্তারের পর আবারও আলোচনায় এসেছেন হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ সেই মাহফুজুর রহমান। আবেদ আলী আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাহফুজের নাম উল্লেখ করেছেন। সেখানেই তিনি জানিয়েছেন, মাহফুজের গাড়িচালক হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কীভাবে তিনি প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িত হয়েছিলেন।
কে এই মাহফুজুর রহমান
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত প্রায় সব কিছুই জানিয়েছেন আবেদ আলী। কারা এর সঙ্গে জড়িত। কাদের কাছে অর্থের ভাগবাটোয়ারা যেত, আর কারা কারা চাকরি পেয়েছেন সব বলে দিয়েছেন তিনি।
আবেদ জানিয়েছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পিএসসিতে প্রশ্নফাঁস শুরু হয়। আর এটা জেঁকে বসে ২৪তম বিসিএসে। পরে ২৫তম ব্যাচে প্রশ্নফাঁস বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই সময় পিএসসির সদস্য হিসেবে এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মাহফুজ। তখন তার ড্রাইভার আবেদ আলীর নেতৃত্বে একটি টিম তৈরি করা হয়। এরা মূলত মাঠ লেভেলে কাজ করতো। কাস্টমার জোগাড় করার দায়িত্ব ছিলো এই টিমের।
এদিকে মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ প্রায়ই বসতেন হাওয়া ভবনে। সেখানে তার চলাফেরা ছিল গডফাদারদের সঙ্গে। এছাড়া গুলশানে ছিল একটি বাড়ি এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ‘ভিন্ন জগত’ নামক একটি রিসোর্ট ছিল।
Advertisement
বিসিএসের চাকরি পেতে যারা মাহফুজকে অর্থ দিত, তাদের এই দুই স্থানে রেখে পরীক্ষার একদিন আগে প্রশ্নপত্র দেওয়া হতো। সেখানে পড়ালেখারও ব্যবস্থা করা হতো। এর পরের দিনই অনুষ্ঠিত হতো পরীক্ষা। একটি বিশেষ জায়গায় তাদেরকে পরীক্ষা নেওয়া হতো। সেখানে পছন্দের লোকদের পরীক্ষক নিয়োগ করা হতো। এরপর পরীক্ষার ফলাফলে মাহফুজের লোকেরাই সর্বোচ্চ নম্বর পেত।
বিএনপি-জামায়াতের সময় এভাবেই মাহফুজুর রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নেন। কিছু ক্ষেত্রে দলীয় নেতাদের পাঠানো তালিকাতেও চাকরি দিতে হতো, তবে সেখান থেকেও অর্থ আদায় করা হতো। কিন্তু সব অর্থ মাহফুজ একা পেতেন না। প্রথমেই মোটা অঙ্ক চলে যেতো হাওয়া ভবনে। বাকী অর্থ ভাগাভাগি হতো মাহফুজ ও আবেদ আলী চক্রের মধ্যে। দুর্নীতির দণ্ড পাওয়ার পর এক সময় জামিনে ছাড়া পান মাহফুজুর রহমান। পরে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
মাহফুজের হাওয়া ভবন চক্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রশ্নফাঁসের যে রমরমা বাণিজ্য গড়ে তোলা হয়েছিল, তা নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাহফুজের নেতৃত্বে সে সময় যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল সে প্রসঙ্গও তোলেন তিনি।
রোববার সংবাদ সম্মেলনে ২৪তম বিসিএসের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির আমলে পরীক্ষা বা চাকরি হতো কোনো পরীক্ষা দিয়ে নয়। হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো। আর ঢাকা কলেজের বিশেষ কামরায় পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে তারা চাকরিকে ঢোকে। কিন্তু এ নিয়ে তখন কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। প্রশ্নফাঁস সেই থেকেই শুরু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালে তার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে এই জিনিসটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিল। আর যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মাহফুজ-আবেদ ক্যাডারদের তালিকা হচ্ছে
মাহফুজ ও আবেদ আলীর হাত ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ থেকে শুরু করেছে একটি সংস্থা। যোগ্যতা ছাড়াই সেইসব ক্যাডারদের মধ্যে রয়েছে চিহ্নিত দলীয় ক্যাডাররা। একটি সূত্র জানিয়েছে, ওইসব ক্যাডাররা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় লিপ্ত। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনারও কাজ চলছে।
পিএসসির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমান ও মক্কেল জোগাড়ের দায়িত্বে থাকা আবেদ আলীর ধরে কারা কারা চাকরি নিয়েছেন তাদের নামও বেরিয়ে আসছে। স্বাস্থ্যের বিতর্কিত মিঠু ঠিকাদারও প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
বিসিএসের প্রায় ক্যাডারেই মাহফুজের প্রশ্নফাঁসে চাকরি হয়েছেন। অনেকেই এখন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও বড় দায়িত্বে রয়েছেন। মাহফুজুর রহমানের সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ চার দলীয় জোটের দলীয় নেতাকর্মীরা বিসিএস ক্যাডারে বেশি ঢুকেছে বলে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
রোববার প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়টি আলোচনায় আসে। তিনি বলেন, বিসিএসের ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা পাশ করে চাকরি করছেন, তাদের চাকরি করার কোনো অধিকার নেই। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে চাকরি করছেন, এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন সেটা খুঁজে দেবে কে? ওরা যদি বলতে পারে যে অমুকের কাছে বিক্রি করেছে- তখন প্রমাণ করতে পারলে সেটি দেখা যাবে। পাশাপাশি সাংবাদিকরা যদি চেষ্টা করে এমন ব্যক্তি খুঁজে বের করে দেয়, তাহলেও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
Advertisement
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমিও বিশ্বাস বেনিফিশিয়ারি যারা, তাদেরও ধরা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ করবে না। প্রশ্নপত্র যারা ফাঁস করে, আর সেই প্রশ্নপত্র যারা ক্রয় করে দুই জনেই অপরাধী, এতে কোনো সন্দেহ নেই।