জাপানপ্রবাসী আরিফুল ইসলাম খুনের ঘটনায় পারভীন আক্তারের আত্মস্বীকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি ,বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ : ‘আমার সংসার তছনছ করে দিয়েছিল আরিফুল। দিনের পর দিন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। গোপন ভিডিও করে তা আমার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠানোর হুমকি দিয়ে মাসে মাসে আমাকে এটিএম বুথের মতো ব্যবহার করেছে। আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করে যখন কানাডা থেকে প্লেনে উঠছিলাম, তখনও জানতাম না- আরিফুল জাপান থেকে ফিরে আসবে। দেশে ফেরার পরপরই আমাকে ফোন করে সে। তখন সে জানতে পারে, আমি দেশে এসেছি। নিজেকে শেষ করার জন্য যে ছুরি কানাডা থেকে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা দিয়ে ওকে মেরেছি।’
Advertisement
ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের মাননীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকারীদের বিচার চাই ।
কুমিল্লা মেঘনা উপজেলার চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম তাজ
বুধবার (৫ জুন) কানাডা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে জাতীয় দৈনিক সমকালের সঙ্গে আলাপচারিতায় আত্মস্বীকৃতি দিয়ে এসব কথা বলেন জাপানপ্রবাসী আরিফুল ইসলাম খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত পারভীন আক্তার।
তিনি বলেন, আমি খুনি, এটাই সত্য; সারা দুনিয়াও জানে। খুন করে কানাডায় চলে এসেছি। তাই অনেকে ভাবতে পারে, বেঁচে গেছি। আসলেই আমি বেঁচে আছি? ২০১৯ সাল থেকে ট্র্যাপে পড়েছি। বহুবার সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলাম। আত্মহত্যা করতে গিয়েছি কয়েকবার।
Advertisement
গত ১৮ মে রাজধানীর বসুন্ধরার একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে আরিফুল ইসলামকে হত্যার পরদিন কানাডায় উড়াল দেন পারভীন। বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে ১৬ মে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। আরিফুল ও পারভীন দু’জনেরই গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। জাপানি এক তরুণীকে বিয়ে করে বছরখানেক ধরে সেখানেই বাস করছিলেন আরিফুল। আর স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসার করতে গত ২ এপ্রিল কানাডায় যান পারভীন।
তিনি বলেন, ‘যেভাবে পাঁচ বছর আমাকে অত্যাচার করেছে, ১৭ মে বসুন্ধরার ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠার পরই সে জোর করে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। এর আগে জাপান থেকে আনা মদ খেয়েছিল আরিফুল। আরও কিছু জিনিস এনেছিল, যা আমার চিন্তারও বাইরে ছিল। এরপর যখন আরিফুল ঘুমিয়ে পড়ে তখন মনে হচ্ছিল, আমার সামনে যাকে দেখছি, তা কোনো মানুষের চেহারা নয়। মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেছে, তা এখন কল্পনাও করতে পারছি না। এখন কানাডায় একটি সেফ হোমে আছি। দায় মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আমি।’
Advertisement
পারভীন জানান, ২০১৬ সালে নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া এলাকার নাজমুল হাসান বাবুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর এক বছর পর তার স্বামী কানাডায় চলে যান। তখন নরসিংদীর একটি কলেজে লেখাপড়া করতেন পারভীন। ২০১৯ সালের দিকে রায়পুরার আরিফুলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই সময় হঠাৎ বড় ধরনের রোগ ধরা পড়ে পারভীনের। ক্যান্সারের প্রথম পর্যায় ছিল সেটি। পাশাপাশি জানতে পারেন, কখনও বাচ্চা নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ সময় তাকে সাহস জোগান আরিফুল। এর পর থেকে ধীরে ধীরে আরিফুলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে এ সম্পর্ক ‘ঘনিষ্ঠ’তায় রূপ নেয়। তখন আরিফুল মাসে ১৪ হাজার টাকার বেতনে ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে ছোট চাকরি করতেন। কিছুদিন পর পারভীন উপলব্ধি করেন, কী করছেন তিনি! এ সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
আরিফুল তার স্ত্রী-সন্তানের কথা গোপন করে উল্লেখ করে তিনি জানান, গাজীপুরে তার প্রথম স্ত্রী ও এক মেয়ে থাকত। এক পর্যায়ে আরিফুলের বিয়ের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। তখন আরিফুল বলতেন, স্ত্রীর সঙ্গে তার বনিবনা নেই। বাচ্চার টানে মাঝেমধ্যে গাজীপুরে যান। প্রতিবছর শেষের দিকে পারভীনের স্বামী কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসতেন। ২০২০ সালে আসার পর প্রথমে জানতে পারেন, আরিফুলের সঙ্গে পারভীনের ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্ক রয়েছে। স্বামীর কাছে সবকিছু স্বীকার করে ক্ষমা চান তিনি। এরপর পারভীনকে দ্রুত কানাডায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
পারভীন বলেন, ‘যখন এ সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই গোপন ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায় আরিফুল। এও বলেছে, পুলিশকে জানিয়েও লাভ হবে না। কারণ, তার রাজনৈতিক হাত লম্বা। দিনের পর দিন আমাকে অসহনীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার শারীরিক অসুস্থতাকে কখনও আমলে নিত না।’
তিনি বলেন, ‘এই নরককুণ্ড থেকে বাঁচতে অনেক সময় এমন প্রার্থনাও করেছি, ঢাকা থেকে নরসিংদীতে যে গাড়িতে আরিফুল ফিরছে, সেটি যেন দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে আরিফুল মারা যায়। আর আমিও মুক্তি পাব। এরই মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভয়-ভীতি দেখিয়ে হলফনামায় জোর করে সই নিয়ে বিয়ের নাটক করে আরিফুল। এর পর আমাকে বলতে থাকে, কানাডাপ্রবাসী স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। একটি আলাদা ফোন আমাকে দেয়া হয়, যেটা দিয়ে আরিফুলের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করা হতো।’
Advertisement
পারভীন বলেন, ‘এসব ঘটনায় আমি গভীর ডিপ্রেশনে চলে গেছি। মরার জন্য কীটনাশক ব্যাগে নিয়ে মাসের পর মাস চলতাম। এটাও ভেবেছি, এসব জেনেও কী করে আমার স্বামী সব সহ্য করছে! আমাকে মেনে নিচ্ছে!’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী প্রতি মাসে কানাডা থেকে যে টাকা পাঠাত, তার অর্ধেক আরিফুল নিয়ে নিত। তার মোটরসাইকেলের তেল খরচ, দামি মোবাইল সেট কিনে না দিলে ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখাত। বাধ্য হয়ে মাসের পর মাস হাজার হাজার টাকা তাকে দেয়া লাগত।’
পারভীন বলেন, ‘নিজে বাঁচতে জাপানি তরুণীর সঙ্গে বিয়ের সব আয়োজন আমি করেছিলাম। ওই তরুণীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক হওয়ার পর কক্সবাজারে হানিমুনে যায় তারা। ওই সময় আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছিল আরিফুল। এর কিছুদিন পর সে জাপানে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর কয়েক মাস কোনো যোগাযোগ করেনি। আমিও ভেবেছি, জাপানি তরুণীর সঙ্গে সুখে আছে। তবে এ বছরের শুরুর দিক থেকে আবার যোগাযোগ শুরু করে। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটায় ঈদুল ফিতরের দিন। হঠাৎ কানাডায় আমার স্বামীর কাছে বেশ কিছু ভিডিও পাঠায় আরিফুল। এরপর মেসেজ করে অশ্লীল কথাবার্তা লিখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে ইঙ্গিত করে নানা হুমকি দেয়া শুরু করে। দ্রুত কানাডা থেকে আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হলে এসব ভিডিও আত্মীয়স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। এতে মানসিকভাবে আমি ভেঙে পড়ি।’
পারভীনের ভাষ্য, ‘এ পরিস্থিতিতে আত্মহননের পথ বেছে নিতে কানাডা থেকে দেশে ফিরেছিলাম। অনলাইনের মাধ্যমে বসুন্ধরার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল আরিফুল। সেখানে ওঠার পর আরিফুল তাকে বলে, ফার্মগেটে একটি হোস্টেল ভাড়া করে দেয়া হবে পারভীনকে। বছরে একবার জাপান থেকে আসবে আরিফুল। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো দরকার নেই। এরপরই তার সঙ্গে জোরপূর্বক নির্যাতন শুরু করে। স্বামী-সংসার ফেলে আসার পর নিপীড়নের শিকার হলে সব ওলটপালট হয়ে যায়।’ পারভীন বলেন, ‘ভেবেছিলাম, আমার স্বামীর কাছে এমন নোংরা ছবি পাঠানোর কারণে হয়তো ক্ষমা চাইবে আরিফুল। হয়তো পুরো বিষয়টি নিয়ে মাফ চাইতে জাপান থেকে আসছে। ঢাকায় এসে ঠিক পুরোনো রূপ দেখা গেল তার। আরিফুলের মোবাইল ফোনসেট হাতে নিয়ে দেখি, আমার নানা ধরনের গোপন ভিডিও। কখন-কীভাবে এসব তুলেছিল, জানি না। কিছু ভিডিও আমাকে বের করে দেখাচ্ছিল সে। এটা আমি মেনে নিতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আরিফুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমাকে একঘরে করে ফেলা হয়। বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কোথায়, কেন যাচ্ছি– প্রতিমুহূর্তে তাকে জানাতে হতো। প্রায়ই মনে হতো, আমার রিমোট কন্ট্রোল ওই পাষণ্ডের হাতে। প্রতি সপ্তাহের কোনদিন কোন সময় তার বাসায় যেতে হবে, এটিও ঠিক করে দিয়েছিল সে। আমার নিজের লাইফ বলতে কিছু ছিল না।’
Advertisement
পারভীন বলেন, ‘কানাডায় ফিরে আবার নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা বারবার মাথায় আসছে। আমি মরে গেলে আমার মা-বাবাসহ পরিবারের কাউকে নিয়ে যেন পুলিশ টানাহেঁচড়া না করে, এটি নিশ্চিত করবেন প্লিজ। আরিফুলকে হত্যার পর একবার স্বামী ফোন করেছিল। কোন মুখে তার সঙ্গে কথা বলব? নিজের জীবনের সঙ্গে তার গোছানো জীবনটাও ধ্বংস করেছি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুনের পর ফোন বন্ধ করে রাখতে পারতাম। সেটা করিনি। এখন আমার আশপাশে কথা বলার মতো কাউকে পাচ্ছি না। কেউ কথা বললে মনে এক ধরনের শান্তি পাই।