বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে বাবা-মায়ের নিঃসঙ্গ ঈদ (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(ভিডিও),বিশেষ প্রতিনিধি ,বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল ২০২৪, ২৮ চৈত্র ১৪৩০ : বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের মাঝে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদছেন বাবা-মা! অতীতের সুখ গল্প আঁকড়ে ধরে বুকে পাথর চেপে জীবনযাপন করছেন। আজ বড় অসহায় তারা। ঈদের দিনও অনেকের খোঁজ নেয়নি সন্তানরা। অথচ জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানের জন্য।

সেই সন্তানদের ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা। বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব জীবন কাটছে তাদের। ফরিদপুরের শান্তি নিবাসে চোখের জলে নিঃসঙ্গ ঈদ কাটছে।

Advertisement

জরিনা বেগম। বয়স ৬০ বছর। চেহারায় বয়সের ছাপ। দুই বছর শান্তি নিবাসে জীবন কাটছে। দুই পুত্র সন্তানের মা তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পরই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ছেলেদের নিয়ে কোনোমতে দিন কাটছিল জরিনা বেগমের। বিপত্তি ঘটল বড় ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পর। ছেলের বউ সংসারে আসার পরই তার ওপর শুরু হয় অত্যাচার। বাড়ি থেকে বের হয়ে পথে পথে কাটছিল তার দিন, এক পর্যায়ে ঠাঁই হয় শান্তি নিবাসে।

জরিনা বেগম বলেন, ‘বড় ছেলে শ্বশুর বাড়ি থাকে। ছোট ছেলে বাড়িতে থাকে। ভালোই ছিলাম, কিন্তু ছেলে বিয়ে দেওয়ার পরই আমার জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। অনেক কাজ করাতো ছেলে বউ। মুখ বুঝে কাজ করতাম। বয়সের কারণে যখন কাজ করতে পারতাম না, তখনই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। ছেলেকে বললাম আমি কোথায় যাব। ছেলে বলল, যেদিকে চোখ যায় সেখানে যাও।’

 

বৃদ্ধাশ্রমের থাকা এ বাবাদের জীবনের গল্প একেকজনের একেকরকম। ঈদের দিনে নাতি-নাতনী ও সন্তানদের কথাই বেশি মনে পড়ছে তাদের। ছবি: সময় সংবাদ

কথাগুলো বলছিলেন আর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। কান্না করতে করতে বলছিলেন, আজ ঈদের দিন, ছেলে, নাতি নিয়ে কতো আনন্দ করার কথা, সেখানে একাই ঈদ করতে হচ্ছে। এখানে অনেক ভালো আছি। সবার সঙ্গে মিলে মিশে ঈদের আনন্দ করতেছি। কিন্তু ছেলের জন্য খারাপ লাগছে।

আরেকজন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। স্ত্রী, সন্তানরা সবকিছু লিখে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সব হারিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন তিনি। এরপর ভবঘুরে সাজ্জাদের ঠাঁই হয় শান্তিনিবাসে। আগের মতো আর সন্তানদের হাতে হাত রেখে যেতে পারেন না ঈদের কেনাকাটা করতে। শান্তি নিবাসের চার দেয়ালের মাঝে মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলেন চোখের পানি। গত ৬ বছর ধরে আছেন শান্তি নিবাসে।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘সবই আমার কপাল। বিয়ে করার পর স্ত্রীর নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলাম। স্ত্রী ও সন্তানরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করি, সেই স্ত্রীও সম্পত্তি লিখে নিয়ে আমাকে বের করে দিল। পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে ঠাঁই হলো শান্তি নিবাসে।’

তিনি বলেন, ‘সন্তান জন্ম দিয়ে ভুল করেছি, সম্পত্তি করেও ভুল করেছি। এত সম্পদ না থাকলে আমার সাথে এমনটি হতো না। এখন আমার কেউ খোঁজ নেয় না। তারা অনেক ভালো আছে। আমিও এখানে ভালো থাকার চেষ্টা করি। ভালোই আছি, ভুলের খেসারত দিচ্ছি।’

সাজ্জাদ হোসেন, জরিনা বেগমই নয় শান্তি নিবাসে রয়েছেন শাহাদাত খান, আয়শা, আনাফিনসহ আরও অনেকেই। সবারই কথা একই রকম।

শান্তিনিবাসে পরিবারহীন বাবা-মায়ের সংখ্যা ১৯ জন। তাদের সবার ঈদ কাটছে পরিবারহীন। যাদের জীবনের সমস্ত সুখকে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন সন্তানের জন্য। সেই সন্তানদের ছাড়া শান্তিনিবাসে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা।

ঈদের দিনের সকালে ছেলে, নাতি, নাতনী ছাড়া মুখে তোলাও যে কতটা কষ্টের, তা একজন মা ছাড়া কেউ বোঝে না। ছবি: সময় সংবাদ

বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ঈদের দিন সকালে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা এলাকায় অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত শান্তিনিবাসে গিয়ে দেখা যায় মলিন মুখে ঈদ উদযাপন করছেন তারা। ঈদের দিন সকালে তাদের দেওয়া হয়েছে উন্নত মানের খাবার। সকালে খিচুড়ি, সেমাই ও ডিম। দুপুরে পোলাও, গরুর মাংস, রোস্ট ও মিষ্টি। রাতেও রয়েছে উন্নতমানের খাবার। দেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক।

Advertisement

শান্তি নিবাসে বর্তমানে ১২ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ রয়েছে। এর মধ্যে দুই জন খুবই অসুস্থ। তাদের চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে এখানে। এর মধ্যে একজন নারী ও একজন পুরুষ কথা বলতে পারেন না।

শান্তি নিবাসের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জীবনে অনেক ভুল করেছি, তাই আমি আজ এখানে। আমি চাকরি করতাম। চাকরির সুবাদে বাইরে বেশি থাকতাম। হঠাৎ দুর্ঘটনায় আমার পায়ের সমস্যা হয়। চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। স্ত্রী পরকীয়া করে টাকা পয়সা নিয়ে চলে যায় অন্যের হাত ধরে। এরপর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনি। শান্তি নিবাসেই হলো শেষ ঠিাকানা। এখানে ভালোই আছি, খাওয়া দাওয়া চিকিৎসা সবই দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, এখানকার সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছি। সবকিছু ভুলে গিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করছি।’

আরেক বাসিন্দা আয়শা বলেন, ‘কেউ নেই আমার। এখানে আছি অনেকদিন। ঈদের আনন্দ এখানকার সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিই। সকালে নতুন পোশাক দিয়েছে, তা পরেছি। সেমাই দিয়েছে, খিচুরি ও ডিম খেয়েছি। দুপুরে মাংস, ভাত, মিষ্টি দিয়েছে। রাতেও ভালো খাবার আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ঈদের দিনই নয়, সারা বছরই এখানে ভালো খাবার দেয়, যত্ন করে। অনেক ভালো আছি। কেউ নেই মনে হয় না।’

শান্তি নিবাসের বাসিন্দাদের দেখভাল করেন শাহানাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘এখানে যারা আছেন সকলের সমানভাবে যত্ন করা হয়। আব্বা-আম্মার মতো করে সকলের খেয়াল রাখি। অনেকেই অসুস্থ আছেন, তাদের দিকে বেশি নজর দিতে হয়।’

সমাজসেবা পরিচালিত শান্তিনিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক তাহসিনা জামান জানান, শান্তিনিবাসে ১২ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ রয়েছেন। এর মধ্যে একজন নারী ও একজন পুরুষ খুবই অসুস্থ, তাদের সুস্থ করতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যারা রয়েছেন তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা এখান থেকেই করা হয়।

তিনি জানান, ঈদ উপলক্ষে সব নিবাসীকে নতুন কাপড় দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঈদের দিন সকালে রুটি-সেমাই, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরে ও রাতে পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরু ও খাসির মাংসসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

Advertisement

তাহসিনা জামান বলেন, ‘চাকরির পেশাগত দায়িত্ব পালনই নয়, এ মা-বাবাদের সেবা করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।’