গোয়েন্দার হাতে কেএনএফ অস্ত্রধারীর ছবিসহ তালিকা

SHARE

কেএনএফের বান্দরবান জেলার প্রধান সমন্বয়কারী চেওসিম বম

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(ভিডি),বান্দরবান প্রতিনিধি ,সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ২৫ চৈত্র ১৪৩০ : কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) অস্ত্রধারীদের ছবিসহ তালিকা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। তথ্যপ্রযুক্তির তদন্ত ও নানামুখী সোর্সের মাধ্যমে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে অভিযানও চলছে। এ ছাড়া কেএনএফ পাহাড়ের যেসব এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেখানে তারা ‘কমিটি’ গঠন করে। এমনকি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে আলাদা কমিটিও রয়েছে। সংগঠনটির প্রধান পলাতক নাথান বমের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের মাধ্যমে এসব কমিটি হয়েছিল। বেশ কয়েকটি কমিটির সশস্ত্র সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

Advertisement

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এদিকে, কেএনএফের বান্দরবান জেলার প্রধান সমন্বয়কারী চেওসিম বমকে (৫৫) শহরতলির শ্যারণপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৩টায় এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-১৫-এর অধিনায়ক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত শনিবার রাতে চেওসিম বমকে শ্যারণপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি কেএনএফপ্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠজন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। রুমা ও থানচির ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে গত রাতে কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে দাবি করে, ‘চেওসিম বম কেএনএফের কেউ নন, তিনি একজন বাগানচাষি।’

পাহাড়ের একাধিক বাসিন্দা ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেএনএফের পরপর কয়েকটি হঠকারী ঘটনার কারণে সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ভয়ে মুখও খুলছেন না। কেএনএফ সদস্যদের সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা মোবাইল ফোন বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাথান বমসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের নেতারা যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সদস্যরা শনিবার রাতে বান্দরবানে বৈঠক করেন। সেখানে বলা হয়, যে কোনো উপায়ে নাথান বম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সুপথে আনার ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া কেএনএফ তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজে কিছু বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিচ্ছে। পাল্টা বিবৃতিতে যাতে সঠিক তথ্য জানানো হয়, এ ব্যাপারে তাদের অনুরোধ করার পরামর্শ দেন কেউ কেউ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক উচ্চ পদের কর্মকর্তা জানান, একসময় নাথান বমের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন মইয়া। এখন এ পদে আছেন কথিত কর্নেল সলোমন। এ ছাড়া নাথানের ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে আরও আছেন রুয়াললিন বম। বর্তমানে তিনি মিয়ানমারের কাচিনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। রুয়াললিন কেএনএফের একটি কথিত ডিভিশনের প্রধান। বান্দরবানে এই সংগঠনের একই ধরনের আরও ছয় থেকে সাতজন ডিভিশন প্রধান আছে। তাদের ছবিসহ তালিকা পেয়েছেন গোয়েন্দারা। মূলত কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) শীর্ষ নেতারা সংগঠনটির যোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণে সহায়তা করছে। নাথান বমের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাপুওয়াল নামে আরেকজন রয়েছে। তাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, ব্যাংক ডাকাতি ও থানায় হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে যৌথ অভিযান চলছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত, কেউ ছাড় পাবে না। আবার কোনো নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক আমরা।

বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালথেন বম বলেন, চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে জরুরি কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে যাচ্ছে না। কেএনএফ হঠাৎ আগ্রাসী ও হঠকারী কাজ করে অন্যদের বিপদে ফেলছে। তারা ভুল বুঝতে পারবে– এটি বিশ্বাস করি। অনেক দিন ধরে কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না।

Advertisement

বান্দরবান র‍্যাব-১৫ অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কেএনএফের কার্যক্রম আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তারা খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। এ কারণে বান্দরবানের সাধারণ মানুষের কাছে কেএনএফ একটা আতঙ্কের নাম। তিনি বলেন, এখানে শান্তি বজায় রাখতে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই শান্তি কমিটির কার্যক্রমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে নামে তারা। সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি এবং ম্যানেজারকে অপহরণের মাধ্যমে তারা ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় বান্দরবানের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে র‍্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা নানা তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করে যাচ্ছে। ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধারের আগে আমাদের অপারেশন কার্যক্রমের পরিকল্পনা কিছুটা শিথিল ছিল, যেহেতু আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুস্থভাবে ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান কার্যক্রম বাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ সেনাবাহিনী সার্বিক সহযোগিতা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, কেএনএফ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিককার প্রধান সমন্বয়ক ও প্রধান উপদেষ্টা এবং রামু ও থানচির ঘটনার অন্যতম পরামর্শক চেওসিম বম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অভিযানের ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে র‍্যাব-১৫ অধিনায়ক এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমাদের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সুয়ালক শ্যারণপাড়ায় শনিবার অভিযান চালাই। তার একতলা ভবনে আমরা ঢোকার চেষ্টা করি। ওই সময় তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের কোনোভাবেই সহযোগিতা করছিল না। পরে বাড়ির ভেতরে একটি আলমারি ভেঙে তাকে বের করে নিয়ে আসি।

Advertisement

চেওসিমকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য তুলে ধরে র‍্যাব অধিনায়ক বলেন, জঙ্গি সংগঠন হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন চেওসিম। তার বাড়িতে বসে এই পরিকল্পনা হয়। এ ছাড়া কুকি-চিনের অন্য সদস্যরা বান্দরবানে যখন আসে, তখন চেওসিম বম তার বাড়িতে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রাখতেন। রুমা-থানচির ঘটনার আগে কিছু সদস্য তার বাসায় এসেছিল। হয়তো তার বাসা থেকেই পরিকল্পনা হয়েছিল।