ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,উখিয়ার হরিণমারা প্রতিনিধি,শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ২৩ চৈত্র ১৪৩০ : পাহাড় বাঁচাতে নিহত বন কর্মকর্তা একমাসেই আটক করেছিলেন ছয়টি ডাম্প ট্রাক। এর মূল্য দিতে হয়েছে তাকে নিজের জীবন দিয়ে। ডাম্পার ট্রাক দিয়ে হত্যার ছয়দিন পরেও পুলিশ হত্যাকারীদের কাউকেই ধরতে পারেনি।
Advertisement
ঘটনাস্থল হরিণমারা’র স্থানীয় রাজনীতিতে বিএনপির আধিপত্য। বন এলাকায় মাটির ব্যবসায় তাদেরই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। তাদের ভয়ে এলাকায় মুখ খোলেন না কেউই। আর ঘটনা ধাপাচাপা দিতে চেষ্টাও চালিয়েছে সিন্ডিকেটটি।
হত্যাকাণ্ডের পর পাহাড় কাটার স্থান এবং ডাম্পার ট্রাক চলাচলের স্থানটি নষ্ট করে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা চালিয়েছে পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ী চক্রটি। পাহাড় কাটার স্থানে ফেলা হয় মাটি, নতুন করে পিলার দিয়ে দেয়া হয় তারের বেঁড়া। আর মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় ট্রাকটির চাকার চাপ।
স্থানীয়রা ভয়ে কারো নাম মুখে না নিলেও রাতের আঁধারে পাহাড় কাটার বিষয়টি স্বীকার করছেন। ওছিউর রহমান ঘোনার আব্দু সালামের স্ত্রী নুরুচ্ছফা সময় সংবাদকে বলেন, ‘নিজের চোখে পাহাড় কারা কাটছে দেখিনি। কিন্তু সকালে দেখি পাহাড়ে মাটি কেটে মাটি নিয়ে গেছে এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। কিন্তু কেউ ছিল না। কারা পাহাড় কাটছে এটাও জানি না, কারা ডাম্পিং করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে এটাও জানি না।’
একই এলাকার কৃষক ছৈয়দ নুর বলেন, ‘রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে ডাম্প ট্রাকে করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন এই কর্মকাণ্ড চলছে। মূলত যাদের ডাম্প রয়েছে এবং যারা এলাকার প্রভাবশালী তারাই এই কাজ করছে।’
এদিকে এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ী চক্রটি বেপরোয়া বলছে বনরক্ষীরা। উখিয়ার রেঞ্জের দোছড়ি বিটের বনরক্ষী সোহেল রানা সময় সংবাদকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ লোপাটের জন্য এ জায়গাটাতে পাহাড় কেটে অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে ভরাট করে দিয়েছে চক্রটি। ডাম্প গাড়ি যে চলছে গাড়ির চাকার ছাপ এখনও রয়ে গেছে। বালুমহালের অনেক চোরাকারবারি রয়েছে, এরা অনেক বড় বড় গডফাদারের ছত্রছায়ায় থাকে। তাদের ক্ষমতার বাইরে কোনোকিছু আমরা করতে পারি না।’
বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান হত্যার ঘটনার পর থেকে অনেকটা পুরুষ শূন্য হরিণমারার ওছিউর রহমান ঘোনা এলাকা। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। রাস্তাঘাটে নেই মানুষের চলাফেরা।
এদিকে বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান হত্যার পর চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম উঠে আসছে। স্থানীয়রা বলছেন, বাপ্পি, ছৈয়দ আলম, তারেক, হেলাল উদ্দিন, আনোয়ার ইসলাম, শাহ আলম, মো. বাবুল, রুবেল, কামাল উদ্দিন, ছৈয়দ হোসন, বদি আলম ও গফুর এদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। আর এদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতারা। কিন্তু এলাকাটি বিএনপি সমর্থকদের অধ্যুষিত হওয়ায় ভয়ে কেউ তাদের নাম মুখে নিচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘কারা পাহাড় কাটছে কারা মাটি বিক্রি করছে এবং কারা ডাম্প চালাচ্ছে এখানে সবাই চেনে। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না। কারণ এদের নাম বলে কি এলাকা ছাড়ব?’
স্থানীয় দোকানদার গিয়াস উদ্দিন সময় সংবাদকে বলেন, ‘এখানে গফুর, হেলাল, বদি আলাম, ছৈয়দ হোসেনসহ অনেকেই পাহাড় বালু ব্যবসা করছে। দৈনিক ১০০ বার ডাম্পার ট্রাক এলাকায় আসা-যাওয়া করছে। সবই তাদের ডাম্পার ট্রাক।’
মিজবাউর রহমান বলেন, এ এলাকায় ১০-১২টি ডাম্প ট্রাক রয়েছে। প্রতিদিনই সকাল, বিকেল ও রাতে এসব গাড়ি নদী বালু ও পাহাড়ের মাটি নিয়ে যায়। সবাই নদী ও পাহাড়ের মাটি নিয়ে ব্যবসা করছে।
হরিণমারা এলাকায় সরকারি পাহাড় কেটে চলছে মাটি বিক্রি। যার প্রমাণও পাওয়া যায় এলাকায়। একটি-দুটি স্থানে নয়, প্রায় ২০টি বেশি স্থানে রয়েছে পাহাড় কাটার চিহ্ন। সংরক্ষিত বনের এসব পাহাড় রক্ষায় সক্রিয় ছিল বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান। গত ১ মাসে এই এলাকা থেকে পাহাড় কাটার সময় অভিযান চালিয়ে জব্দ করেন ছয়টি ডাম্পার ট্রাক। আর জড়িতদের বিরুদ্ধে দেন একাধিক মামলা। যার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ী চক্রটি।
Advertisement
বনবিভাগ বলছে, পাহাড়খেকো ও বালু ব্যবসায়ী চক্রটি পরিকল্পিতভাবে বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানকে হত্যা করেছে। আর হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।
দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়ার রেঞ্জের কর্মকর্তা গাজী মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘বিট অফিসার সাজ্জাদুজ্জামান সে আমার সঙ্গে এই রেঞ্জে ইতিপূর্বে উখিয়া সদর বিটে বিট অফিসার ছিল, ভালুকিয়া অফিসে বিট অফিসার ছিল, ওয়ালা বিটে বিট অফিসার ছিল। এরপর এখন দায়িত্ব পালন করছিল দোছড়ি বিটে বিট অফিসার হিসেবে। সে একজন সক্রিয় বিট অফিসার। গত মার্চ মাসে সে ছয়টা ডাম্প ট্রাক জব্দ করেছে। সব অভিযান তার নেতৃত্বে হয়েছে। তাই বালু ব্যবসায়ী ও পাহাড়খেকো সিন্ডিকেটটি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।’
গাজী মোহাম্মদ শফিউল আলম আরও বলেন, ‘উখিয়া উপজেলার হরিণমারা এটা একটা খারাপ এলাকা। এখানে একটা বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। আমরা যে মামলাটা করেছি মামলার প্রত্যেকটা আসামি কোনো না কোনোভাবে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। কোনো না কোনোভাবে তারা বালি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ কারণেই আমরা এই আসামিগুলোকে এ মামলাই অন্তর্ভুক্ত করেছি। যারা পাহাড় কাটে তারা ওই এলাকার চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী।’
দক্ষিণ বনবিভাগের সিনিয়র সহকারী বন সংরক্ষক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা অবশ্যই ক্ষুব্ধ। কারণ হচ্ছে যারা প্রকৃত আসামি তাদেরকে অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে। এ হত্যা মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি, যেন সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়।’
Advertisement
বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান হত্যার ছয় দিন পার হলেও এখনও পর্যন্ত মামলার ৫ নম্বর আসামিকে গ্রেফতার এবং ডাম্প ট্রাকটি জব্দ করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পর ট্রাকটির নম্বরও মুছে দেয় জড়িতরা। পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত; জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
গত ৩১ মার্চ ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ায় সংরক্ষিত বনের পাহাড় কেটে মাটি পাচারকালে আটকানোর সময় ডাম্পার ট্রাকটি চাপা দিয়ে হত্যা করে বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানকে।