যশোরের বেনাপোলে নিখোঁজ তৃতীয় লিঙ্গের রেশমার মরদেহ উদ্ধার। ছবি: ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪ : যশোরের বেনাপোলে কবরস্থান থেকে নিখোঁজ তৃতীয় লিঙ্গের রেশমার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
সোমবার (১১ মার্চ) বিকেলে বেনাপোল পৌরসভার কাগজপুকুর কবরস্থান থেকে রেশমার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
Advertisement
রেশমা বেনাপোল পৌরসভার কাগজপুকুর গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম জাফর।
এ দিকে এ ঘটনায় ফারুক নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। ফারুক একই গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে।
বোনাপোল পোর্টথানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন ভক্ত এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে বেনাপোল পৌরসভার কাউন্সিলর শাহিন আহম্মেদ জানান, রেশমার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর তিনি একা কাগজপুকুর গ্রামে বসবাস করতেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তার নিখোঁজের গুঞ্জন ওঠে। সোমবার বিকালে কাগজপুকুর গোরস্তানের একটি গর্ত থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এ সময় গ্রামবাসী পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ গর্তে দেখতে পায় মরদেহটি রেশমার। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে।
তৃতীয় লিঙ্গ ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর পর লাশ সৎকার নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। বিষয়টি জানার পর শেরপুরে সরকারি গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী হিজড়াদের জন্য পৃথক কবরস্থান নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান। সেই সঙ্গে জেলার তালিকাভুক্ত ৫২ জন হিজড়ার মধ্যে যে কারও মৃত্যু ঘটলে তিনি তার মরদেহ সৎকার এবং কাফন-দাফনের সব ব্যয় ব্যক্তিগতভাবে বহনের দায়িত্ব নেওয়ার কথাও জানান।
শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থার ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দানকালে পুলিশ সুপার এমন ঘোষণা দেন।
রোববার সন্ধ্যায় শেরপুর সদর উপজেলার আন্ধারিয়া-সুতিরপাড় এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর গুচ্ছগ্রাম প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেককাটা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান তার বক্তব্যে হিজড়াদের পাশে থেকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, হিজড়াদের মৃত্যুর পর তাদের শেষকৃত্য নিয়ে তারা অনেক সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হয়। সেই সমস্যা সমাধানে তাদের জন্য কবরস্থানের জায়গা আমি নিজ অর্থায়নে করে দেব। এজন্য তিনি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে সুবিধাজনক একটি স্থান নির্বাচনে তাকে সহযোগিতা করার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানে প্রিয় অতিথি পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) সভাপতি এসপি পত্নী ফারজানা হক মৌ বলেন, পুনাক সাম্প্রতিক সময়ে গণমানুষ বিশেষ করে নারী সমাজের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। পুনাক নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন, সমাজের দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে দেশের নারী সমাজের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছে। পুনাকের মানবিক সেবার অংশ হিসেবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য পুনাক অনেক রকম কর্মপরিকল্পনা ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সবসময় পাশে থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, হিজড়ারা যে যেই বিষয়ে পারদর্শী তাকে সেই বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে পুনাক। সেই সঙ্গে শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থার সব সদস্যদের মাঝে পুনাকের পক্ষ থেকে সামনে শীতের কম্বল বিতরণেরও ঘোষণা দেন।
আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাট ফরম জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটির আহবায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ। তিনি তার স্বাগত বক্তব্যে শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থার সদস্যদের জীবনমান ও তাদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বর্ণনা করেন এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে সংস্থার শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কী কী উন্নয়ন করলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে- সেসব বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।
শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থার সভাপতি নিশি সরকারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম, কামারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. সারোয়ার জাহান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বারী চাঁন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, শেরপুরে তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে তাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধকরণ করেছে নাগরিক প্ল্যাট ফরম জনউদ্যোগ শেরপুর। জনউদ্যোগের অনুপ্রেরণায় ২০১৮ সালে গঠন করা হয় শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থা। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুবের প্রচেষ্টায় জেলা সমাজ সেবা বিভাগ জেলার ৫২ জন হিজড়াকে তালিকাভুক্ত করে এবং আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
তৎকালীন পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তালিকাভুক্ত সকল হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকাভুক্ত করা হয়।
জেলা প্রশাসনের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহায়তায় শেরপুর সদরের ১২নং কামিরয়া ইউনিয়নের আন্ধারিয়া সুতিরপাড় এলাকায় ২ একর খাসজমির উপর নির্মিত হয় সরকারিভাবে দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর গুচ্ছ গ্রাম প্রকল্প। ২০২১ সালের ৭ জুন তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়া জনগোষ্ঠীর গুচ্ছগ্রামে ৪০ জন হিজড়ার মাঝে জমিসহ ঘর প্রদান করে পুনর্বাসন করা হয়।
এরপর থেকে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, সংসদ সদস্য হুইপ আতিউর রহমান আতিক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে হিজড়াদের উন্নয়নে। চলছে বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ।
Advertisement
শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিশি সরকার বলেন, হিজড়াদের বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জেলা প্রশাসন আমাদের আবাসন করে দিয়েছেন। আমাদের আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, আমরা এসপি ও তার পত্নীর কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আজ আমাদের সঙ্গে একটি দিন কাটিয়েছেন, আমাদের অনুষ্ঠানের কেক কেটেছেন, আমাদের আনন্দে শরিক হয়েছেন। আমাদের মরদেহ দাফনের জন্য কবরস্থান নির্মাণ ও সৎকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই।