ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ইসলামী বিশ্ববিদ্যাল প্রতিনিধি,বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ছাত্রলীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় অনুসারীরা বিশেষ করে জুনিয়রকর্মীরা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ‘বড়ভাই’দের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে (শেলটারে) তারা নানারকম অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাদের লাগামহীন কর্মকাণ্ডে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ছাত্রী হলের গণরুমে নবীন শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার বছর না ঘুরতেই লালন শাহ হলের গণরুমে নবীন শিক্ষার্থীকে একই স্টাইলে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জুনে একই ছাত্র হলের একই কক্ষে আরেক নবীন ছাত্রকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এসব নির্যাতনের সঙ্গে ছাত্রলীগের জুনিয়রকর্মীরা জড়িত। অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় গত বছর কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে আজীবন বহিষ্কার করে।
এরপরও ছাত্রলীগকর্মীরা প্রতিনিয়ত হলগুলোতে র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। দু-একটি ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও ছাত্রলীগ নেতারা অধিকাংশ ঘটনা ধামাচাপা দেন। এ কারণে অভিযুক্তরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলেও ছাত্রলীগ নেতারা তাদের অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য করে। মদদপুষ্টকর্মীদের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খোলেন না ভুক্তভোগীরা।
এ কারণে প্রথমবর্ষে থাকতেই জুনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরা ভয়ংকর হয়ে উঠে। এসব কর্মী নিজেদের প্রভাবশালী নেতার অনুসারী দাবি করে নবীন শিক্ষর্থীদের আতঙ্কের মধ্যে রাখে। নিয়মিত র্যাগিংয়ের শিকার হলেও ভুক্তভোগীরা হলে সিট রক্ষায় নীরবে সবকিছু সহ্য করে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে নির্যাতনকারী কর্মীদের ‘বড়ভাই’রা তখন তৎপর হয়ে উঠেন। প্রশাসনের যথাযথ তদারকির অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় ও অন্য নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় কর্মীরা ভয়ংকর হয়ে উঠছে বলেও মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবকরা।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নিষিদ্ধ থাকলেও লালন শাহ হলে ৭ ফেব্রুয়ারি রাতভর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের হুমকির ভয়ে ওই নবীন শিক্ষার্থী মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
এ নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুদাচ্ছির খান কাফি ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাগরসহ কয়েকজন। তারা সবাই শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী ও কর্মী। এ নির্যাতনের পর শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী নাসিম আহমেদ মাসুম গণরুমে ভুক্তভোগী-অভিযুক্ত ও অন্যদের নিয়ে আলোচনায় বসেন।
Advertisement
অভিযুক্তরা ঘটনা স্বীকার করলেও মাসুম ভুক্তভোগীকে ঘটনা বাইরে না বলার জন্য হুমকি দেন। এ কারণে ভুক্তভোগী প্রথমে ঘটনা স্বীকার করলেও ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে পড়ে তা অস্বীকার করেন। ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা ওই কক্ষ পরিদর্শন করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নির্দেশে গণরুম ফাঁকা করে দেওয়া হয়। এছাড়া ভুক্তভোগীকে মুখ না খুলতে নেতারা হুমকি দেন। এরপর কড়া প্রহরার মধ্যে তাকে রাখে ছাত্রলীগ। ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি’ বলেও তাকে দিয়ে হল প্রভোস্ট বরাবর লিখিত অভিযোগ দিতে বাধ্য করে।
এর আগে জুনে হলটিতে দুই ছাত্রলীগকর্মীর বিরুদ্ধে র্যাগিংয়ের অভিযোগ করে এক ভুক্তভোগী প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতারা তার সঙ্গে কথা বলার পর তিনি অভিযোগ তুলে নেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
Advertisement
র্যাগিং বন্ধ না হওয়াকে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে মনে করছেন সিনিয়র শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. আব্দুল মুঈদ বলেন, শাসক দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এগুলো ঘটছে। সুশাসনের অভাব থেকে এমনটা হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও ঘটছে। এছাড়া দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এমন ঘটনা থামছে না।
প্রক্টর প্রফেসর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, র্যাগিং নিয়ে আমরা সব সময় শক্ত অবস্থানে আছি। তদারকির কোনো ঘাটতি নেই। প্রশাসনের কোনো ধরনের গাফিলতিও নেই। ঘটনা জানার পর ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগ কাউকে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করে না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ব্যক্তি উদ্যোগে তারা (অপরাধীরা) এসব কর্মকাণ্ড ঘটায়। ভুক্তভোগীকে ছাত্রলীগ কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করেনি। আর যারা অভিযুক্ত তাদের আমি ভালোভাবে চিনি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকটের কারণে গণরুম কালচার থাকায় এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, আগেও র্যাগিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্তদের ছাত্রলীগ শাস্তির আওতায় এনেছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমরা চাই-প্রশাসনের তদন্তে সঠিক বিষয় উঠে আসুক। ছাত্রলীগ কখনো কোনো কর্মীকে র্যাগিং করতে উৎসাহিত করে না।
Advertisement
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন : ৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মাকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য সদস্যরা হলেন-আইন প্রশাসক আনিচুর রহমান ও সহকারী প্রক্টর মিঠুন বৈরাগী। এছাড়া হল প্রশাসনের তদন্ত কমিটিতে আবাসিক শিক্ষক ড. আলতাফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য সদস্যরা হলেন-আবাসিক শিক্ষক আবদুল হালিম, হেলাল উদ্দিন ও হলের সহকারী রেজিস্ট্রার জিল্লুর রহমান।