ত্রিশ বছর আগের সগিরা মোর্শেদ হত্যা রহস্য কীভাবে উদঘাটন করল পিবিআই

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আইন আদালত প্রতিনিধি,বুধবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ : প্রায় ত্রিশ বছর পর নাটকীয়ভাবে উন্মোচিত হয়েছে সগিরা মোর্শেদ সালাম নামে এক নারীর হত্যা রহস্য।

Advertisement

ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫শে জুলাই বিকেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন রিকশায় করে যাবার পথে সেই মহিলার অলংকার ছিনতাইয়ের চেষ্টার সময় বাধা পেয়ে তাকে গুলি করে দু’জন লোক ।

কিন্তু আসলে এটা ছিনতাই ছিল না, ছিল এক পরিকল্পিত হত্যাকান্ড – যার পেছনে ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এক দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

সঠিক তথ্য প্রমাণ এবং নানা চাপের মুখে বছরের পর বছর ঝুলে ছিল এই মামলার তদন্ত কাজ। তবে পিবিআই এর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অবশেষে প্রায় তিন দশক পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন চার ব্যক্তি।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন নিহতের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন, মিসেস শাহীনের ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা। তারা চারজনই এখন কারাগারে।

পারিবারিক প্রতিহিংসার শিকার হবার কারণেই মিসেস সালামকে হত্যা করা হয়েছিল – জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

‌আঠাশ বছর ধরে ফাইলবন্দি থাকার পর চলতি বছরের ২৬ জুন মামলার উপর স্থগিতাদেশ তুলে নেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন।

অধিকতর তদন্তের জন্য ১১ জুলাই আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন – পিবিআইকে দায়িত্ব দেন ।

৬০ দিনের মধ্যে মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষ করতে একইসঙ্গে তদন্ত শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেয় আদালত।

শুরু থেকে পুরো তদন্ত তদারকির দায়িত্বে ছিলেন পিবিআই এর পুলিশ সুপার মোঃ. শাহাদাত হোসেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন তদন্তের আদ্যোপান্ত।

Advertisement

ঘটনার ত্রিশ বছর পর মূল প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে বের করা

আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর পিবিআই এর তদন্ত দল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে মামলার ফাইলটি নিয়ে আসেন।

পুরো ঘটনা বিশ্লেষণে তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ছিনতাইয়ের জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে কি কোন খুন হতে পারে?

এরপর ঘটনাস্থল একাধিকবার পরিদর্শন করে এবং খোঁজ খবর নিয়ে তারা জানতে পারেন যে এই এলাকায় বহুবার চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কখনও কাউকে হত্যা করা হয়নি।

বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিকসা চালক আবদুস সালামতে খুঁজে বের করা। যার বয়স বর্তমানে ৫৫ বছর।

মামলার ফাইলে তার ঠিকানা দেয়া ছিল জামালপুর জেলায়। সেটার সূত্র ধরে পুলিশ তার অবস্থান নির্ণয়ের করতে গিয়ে জানতে পারেন যে তিনি বর্তমানে ঢাকায় আছেন। কিন্তু তার কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি।

এরপর পুলিশ টানা কয়েক মাস ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের আশেপাশের রিকশা গ্যারেজগুলোয় প্রবীণ রিকশা চালকদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন।

এক পর্যায়ে এক প্রবীণ রিকশা চালক আবদুস সালামের খোঁজ দেন।

তবে তিনি তার কোন ঠিকানা দিতে পারেননি। আবদুস সালাম প্রতিদিন একটি দোকানে আসেন, পুলিশকে ওই রিকশাচালক সেই দোকানের ফোন নম্বরটি দেন।

পরে ওই নম্বরে তদন্ত কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলে দোকান কর্মকর্তা জানান আবদুস সালাম তার পাশেই রয়েছে।

পরে ফোনে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এই ১৯৮৯ সালের ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা।

আবদুস সালাম বলেন যে তিনি এ বিষয়ে জানেন। পরে তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

Advertisement

যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল মিসেস সগিরাকে

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রিকশাচালক আবদুস সালাম জানান, ঘটনার দিন বিকেলে ভিকারুন্নেসা স্কুলের কাছে মোটর সাইকেলে করে আসা দুই যুবক তাদের রিকশার পথ আটকে দাঁড়ায়।

ওই দুই যুবক সে সময় দেখতে কেমন ছিলেন তার শারীরিক গড়নের বর্ণনা দেন আবদুস সালাম। যা পরবর্তীতে পুলিশের কাজে লাগে।

প্রথমে তারা মিসেস সালামের হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নেয় এবং তার পরনে থাকা স্বর্ণের বালা ধরে টানাটানি শুরু করে।

এসময় মিসেস সগিরা তাদের একজনকে দেখে বলেন, ‘আমি আপনাকে চিনি’, এবং তার নামটিও বলেন।

এই কথা বলার পরই অপর যুবক পিস্তল বের করে মিসেস সগিরাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোঁড়েন।

এ সময় আশেপাশে লোকজন জড়ো হতে শুরু করলে তারা আরও কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে মৌচাকের দিকে পালিয়ে যায়।

রিকশাচালক তাদেরকে তাড়া করলেও রাস্তার কোন মানুষ অভিযুক্ত দুজনকে থামাতে আসেনি বলে জানান মি. শাহাদাত।

এদিকে ঘটনাস্থল অতিক্রম করার সময় এক ব্যক্তি মিসেস সগিরাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ পুলিশ।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশ পুলিশ।

Advertisement

ছিনতাই নয়, পরিকল্পিত খুন

“মিসেস সগিরা যেহেতু ছিনতাইকারীকে চিনতে পেরেছেন এবং তার পরপরই তাকে হত্যা করা হয়েছে, এর অর্থ খুনিদের কেউ তার পরিচিত হবেন। এবং তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।” বলেন মি. শাহাদাত।

এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত তিন মাসে বিভিন্ন সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর পারিবারিক কলহের বিষয়টি সামনে আসে।

এরপর রিকশাচালক হত্যাকাণ্ডে জড়িত দু’জনের যে শারীরিক বর্ণনা দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে মিসেস শাহীনের ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও মারুফ রেজার মিল পান।

চলতি মাসের ১০ তারিখ মি. রেজওয়ানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১২ নভেম্বর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন। ১৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন মারুফ রেজা। পরদিন খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তারা।

পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে মি. রেজওয়ানকে বলেন, “বোন শাহিন ও ভগ্নীপতি হাসানের পরিকল্পনায় তিনি ও মারুফ রেজা হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন।

Advertisement

পারিবারিক কলহের কারণ উদঘাটন হয় যেভাবে

পারিবারিক কলহের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে বলে পিবিআই এর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮৫ সাল থেকে।

নিহতের স্বামী এবং বাদী সালাম চৌধুরী তার তিন ভাইয়ের মধ্য সবার কনিষ্ঠ।

চাকরি সূত্রে মি. সালাম তার পরিবারকে নিয়ে ইরাকে থাকলেও ১৯৮৪ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়।

তখন থেকে তিনি ঢাকায় রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।

দোতালা বাসার নীচতলায় বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর থাকতেন। ওপরের তলায় থাকতেন সালাম দম্পতি ও তাদের তিন মেয়ে।

মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী স্ত্রী-সন্তানসহ লিবিয়ায় থাকলেও ১৯৮৫ সালে তারাও দেশে ফিরে আসেন।

তারা প্রথম কিছুদিন ওই বাড়ির নীচ তলায় থাকার পর দ্বিতীয় তলায় তার সালাম দম্পতির বাসার একটি রুমে সপরিবারে থাকতে শুরু করেন।

সে সময় থেকেই মিসেস শাহিনের সঙ্গে মিসেস সগিরার বিভিন্ন বিষয়ে কলহ শুরু হয়।

এভাবে ছয় মাস থাকার পর ১৯৮৬ সালে বাড়ীর তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান তার পরিবার তৃতীয় তলায় ওঠেন।

এই সময়ে তৃতীয় তলা হতে আবর্জনা ফেলাসহ আরও নানা কারণে দুই জা’য়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে।

মিসেস শাহিনের দাবি তিনি স্বল্প শিক্ষিতা বলে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হতো। অন্যদিকে বাদী সালাম চৌধুরী বলেন, তার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা, চাকরিজীবী হওয়ায় সবাই ঈর্ষান্বিত ছিল।

মিসেস সালামকে শায়েস্তা করতে হাসান আলী চৌধুরীর ও তার স্ত্রী শাহিন এই হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং ২৫ হাজার টাকায় মারুফ রেজার সঙ্গে চুক্তি করেন বলে জানান পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী মিসেস সগিরা যখন মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যান তখন সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় সগিরাকে দিনেদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বনজ কুমার মজুমদার, প্রধান, পিবিআই

ছবির উৎস,PBI

ছবির ক্যাপশান,বনজ কুমার মজুমদার, প্রধান, পিবিআই

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অভিযুক্তরা পুলিশকে যা বলেছে

অভিযুক্ত চারজন পুলিশকে আলাদাভাবে জবানবন্দি দিলেও সবার বক্তব্যে ও ঘটনার ধারা বর্ণনায় মিল পাওয়া যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই দুপুরে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন এবং জানান সেখানে তিনি যেন মারুফ রেজার সঙ্গে দেখা করেন।

মারুফ রেজাকে চেনার জন্য তার শারীরিক বর্ণনাও দেন তিনি। মি. রেজওয়ানকে পাঠানোর কারণ তিনি যেন মিসেস সগিরাকে চিনতে পারেন।

মি. হাসানের বাসায় যাতায়াতের কারণে তিনি মিসেস সগিরাকে চিনতেন।

পরে নির্ধারিত সময়ে ঘটনাস্থলে মি. রেজওয়ানের সঙ্গে মোটর সাইকেল করে মারুফ রেজা দেখা করতে আসেন।

এরপর তারা দুজন সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের কাছে অপেক্ষা করতে থাকেন।

মিসেস সগিরাকে রিকশায় করে আসতে দেখে তারা কিছুদূর ফলো করার পর মিসেস সগিরার রিকশার পথ আটকান এবং হাত ব্যাগ নিয়ে নেন এবং হাতের চুড়ি ধরে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করেন।

তখন মি. রেজওয়ানকে দেখে মিসেস সগিরা বলে ওঠেন, “এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি রেজওয়ান, এখানে কেন তুমি?”

এর পরপরই মারুফ রেজা পিস্তল বের করে মিসেস সগিরাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি করেন। একটি তার ডান হাতে লাগে এবং আরেকটি বাম বুকে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়।

তখন মারুফ রেজা আরও কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে মোটর সাইকেলে করে আনাস মাহমুদকে নিয়ে পালিয়ে যান।

হাইকোর্ট।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,হাইকোর্ট।

মামলার জট

ওই দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন মিসেস সগিরার স্বামী সালাম চৌধুরী।

গণমাধ্যমকে দেয়া পিবিআই এর ভাষ্য অনুযায়ী হত্যার এক বছরের মাথায় ১৯৯০ সালে মিসেস সালাম হত্যা মামলায় মন্টু ওরফে মরণ নামে একজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।

তবে মামলাটির বিচার কাজ চলাকালে প্রশ্ন ওঠে: হত্যাকাণ্ডের সময় দু’জন ঘটনাস্থলে থাকলেও আসামি একজন কেন?

সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালে মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা।

তার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচার কাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত।

পরের বছর হাইকোর্ট থেকে বলা হয়, এই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচার কাজ স্থগিত থাকবে। তারপর থেমে যায় সব ধরণের তদন্ত কাজ।

বাদী সালাম চৌধুরী অভিযোগ করেন, তাকে মামলা তুলে নিতে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়েছিল।

তিনি মামলা না তুললেও যেকোনো সময় হামলা হতে পারে – এমন আতঙ্কে মামলা এগিয়ে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগের সাহস করেননি।

মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা সম্প্রতি বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে রাষ্ট্রপক্ষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়।

চ্যানেল 24 এর অনুসন্ধানের পর পাল্টে যায় যে মামলার আসামি: রায় কাল

৩৫ বছর আগে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় খুন হন সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪)। সেই ঘটনায় করা মামলায় রায়ের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত। আগামীকাল (৮ ফেব্রুয়ারি) আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইনের আদালত।

এই মামলার আসামিরা হলেন-সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু মণ্ডল।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন সাগিরা মোর্শেদ। বলা হচ্ছিলো ছিনতাইকারীর হাতে খুন। কিন্তু ৩০ বছর পর চ্যানেল 24-এর অনুসন্ধানে উঠে আসে এ মামলার অজানা রহস্য। জানা যায় পারিবারিক বিরোধের জেরে হয় এই হত্যা।

১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননেসা স্কুলে মেয়েকে আনতে গিয়ে খুন হন সাগিরা মোর্শেদ। সেদিন রাতেই  রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন তার স্বামী সালাম চৌধুরী। প্রথমে ছিনতাই মামলা হলেও ২০১৯ সালের ২০ জুন চ্যানেল 24-এর অনুষ্ঠান আপনার আদালতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, যা পরে  হাইকোর্টের নজরে আনেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। পরে সে সুত্র ধরে পাল্টে যায় পুরো ঘটনা, পিবিআই প্রধান জানান, এটি একটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, সগিরা মোর্শেদের পরিবারের সঙ্গে আসামি শাহীনের বিভেদ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া সগিরাকে অনেক অপছন্দ করতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সগিরা-শাহীনেরও মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্বোধন করা নিয়েও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল।

সগিরার কাজের মেয়েকে মারধর করে আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী। এ নিয়ে পারিবারিক বৈঠকে শাহীন সগিরাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। আসামিরা নিজেদের বাসায় বসে সগিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ডা. হাসান আলী তার চেম্বারে অপর আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় হত্যার চুক্তি করে।

তদন্তের পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে উঠে আসে সগিরা মোর্শেদকে কীভাবে হত্যা করা হয়।

ডা. হাসান আলী চৌধুরী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ইস্কাটনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। আসামি মারুফ রেজা তার রোগী ছিলেন। সে শহরে মাস্তানি করতো। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি তাকেই ঠিক করেন। তার সাথে ২৫ হাজার টাকায় চুক্তি হয় এ কাজের জন্য। কিন্তু সে সগিরা মোর্শেদকে চিনতেন না। এজন্য তার শ্যালককে দায়িত্ব দেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।

১৯৮৯ সালের ২৪ জুলাই সগিরা মোর্শেদের মেজো বোন আমেরিকা থেকে ঢাকায় আসেন। এজন্য সগিরা মোর্শেদ ও আব্দুস সালাম তাদের রাজারবাগের বাসায় অনুষ্ঠান করেন সেখানে সগিরা মোর্শেদের ভাই ডা.গওজ নেওয়াজ উপস্থিত হতে পারেননি। গওজ নেওয়াজকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য সগিরা মোর্শেদ ২৫ জুলাই বড় মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে নামিয়ে দিয়ে মেঝ মেয়ে ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ধানমন্ডি বাবার বাসায় যান।

ওইদিনই বিকেল ৪টার দিকে সগিরা মোর্শেদ বাবার বাসা থেকে রাজারবাগে স্বামীর বাসায় ফিরে আসেন। সগিরা মোর্শেদের বড় মেয়ে সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ডে শিফটে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। তার স্কুল ছিলো দুপুর সোয়া একটা থেকে। মা বড় মেয়েকে নিয়মিত রিকশায় স্কুলে আনা নেওয়া করতো।

বিষয়টি ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী শাহিন এবং শ্যালক আনাস মাহমুদ জানতো। ২৫ জুলাই হাসান আলী চৌধুরী দুপুর দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে আনাসকে মৌচাকে গিয়ে মারুফ রেজাকে যেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেয়। হাসান আলী চৌধুরীর কাছ থেকে বিস্তারিত টেলিফোনে জেনে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে বাসে, পরে টেম্পুতে করে বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে মৌচাক পৌঁছান। আনাস পৌঁছানোর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে মৌচাক পৌঁছান। মোটর সাইকেলে করে তারা দুই জনে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে চলে যায়। তারা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গেটের একটু দূরে মোটরসাইকেলে বসে সগিরা মোর্শেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সগিরা মোর্শেদ বড় মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে আনার জন্য বাসা থেকে বের হন। চার টাকায় ছালাম মোল্লা নামে এক রিকশাচালকের রিকশা ভাড়া করে স্কুলের দিকে রওনা দেন। মালিবাগ মোড় পেট্রোল পাম্পের সামনে গিয়ে মৌচাকের গলির ভিতর দিয়ে সগিরা মোর্শেদের রিকশাটি সিদ্ধেশ্বরীর মাঝামাঝি অতিক্রমকালে আগে থেকে অপেক্ষারত  আনাস মাহমুদ আঙ্গুল দিয়ে মারুফ রেজাকে ‘এটা সগিরা মোর্শেদ’ বলে চিনিয়ে দেয়। মারুফ রেজা তাৎক্ষণিকভাবে মোটর সাইকেলে রিকশা কিছুক্ষণ ফলো করে। পরবর্তীতে রিকশার সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড় করায়। তারা দুজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ে। মারুফ রেজা সগিরা মোর্শেদের হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। স্বর্ণ টানা হেঁচড়া করতে থাকেন। সগিরা মোর্শেদ সামান্য চিৎকার চেচাঁমেচি করতে থাকে। মারুফ রেজা তাকে থ্রেট করে। সগিরা মোর্শেদ ওই সময় আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলে। বলে,‘তুমি তো রেজওয়ান, তোমাকে আমি চিনি। তুমি এখানে কেন।’এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা কোমরে থাকা রিভলবার বের করে এক রাউন্ড গুলি করে। প্রথম গুলিটি সগিরা মোর্শেদের ডান হাতের কনুইয়ের নিচে লাগে। আনাস মারুফ রেজাকে গুলি করতে নিবৃত্ত না করলে মারুফ আরেক রাউন্ড গুলি করে। দ্বিতীয় গুলি সগিরা মোর্শেদের বুক ভেদ করে সোজাসুজি পিঠ দিয়ে বের হয়ে রিকশার হুড ছিদ্র হয়ে যায়।

আনাস মাহমুদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, সগিরা মোর্শেদের বুকে গুলি লাগার সাথে সাথে তিনি রিকশার বাম দিকে হেলে পড়েন। তার পুরো শরীরসহ রিকশা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। সগিরা মোর্শেদকে দ্বিতীয় গুলি করার পর আনাস মাহমুদ মারুফ রেজাকে বলেন, চলো পালাই। তারা সগিরা মোর্শেদের ব্যাগ ফেলে দেয়। সগিরা মোর্শেদের হাতে স্বর্ণের বালা থেকে যায়। ভীতি ছড়ানোর জন্য মারুফ রেজা তাৎক্ষণিক উপরের দিকে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর তারা সেখান থেকে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামনে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সগিরা মোর্শেদকে বহনকারী রিকশাচালক ছালাম মোল্লা একটি ইট হাতে হ্জ্যাাকার, হাইজ্যাকার বলে চিৎকার করতে করতে ধাওয়া করে। শান্তিনগরের কাছে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামনে আনাস মাহমুদকে মারুফ রেজা মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে দেন। এদিকে রিকশাচালক ফিরে এসে দেখেন সগিরা মোর্শেদ নেই। রিকশায় রক্ত দেখতে পাই।  পরে তিনি রমনা থানায় গিয়ে বিষয়টি জানান।

মামলাটি তদন্ত করে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) এর পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। চার্জশিটে সগিরা মোর্শেদকে ২৫ হাজার টাকা খুনের চুক্তির বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিকৃত ২৫ হাজার টাকার মধ্যে হাসান আলী মারুফ রেজাকে ১৫ হাজার টাকা দেন। ১০ হাজার টাকা পরে দেওয়ার কথা বললেও তিনি আর তাকে সেই টাকা দেননি।

২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত সগিরা মোর্শেদের ভাসুরসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৩১ বছর পর এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর গত বছরের ১১ জানুয়ারি মামলার বাদী ও সগিরা মোর্শেদের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

পরে এ বছর ২৫ জানুয়ারি ৩৫ বছর আগের মামলার রায়ের জন্যে আজকের দিন ধার্য করেন আদালত।