ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি), প্রতিনিধি,শনিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ : সাইবার প্রতারণার অভিযোগে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (৩০) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) গাইবান্ধা জেলার সদর থানার ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি গাইবান্ধা জেলার সদর থানার খোলাবাড়ি গ্রামের সাইদার হোসেনের ছেলে।
Advertisement
আনোয়ার দীর্ঘদিন ধরে মোহাম্মদ মহসীন (MD Mohshin) নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি চালিয়ে আসছেন। ওই আইডিতে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনের মূল আইডির অনুরূপ ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করেন তিনি। ম্যাসেঞ্জারে সেই আইডি থেকে ওসি মহসীন সেজে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করতেন।
এদের মধ্যে কারও সঙ্গে আপত্তিকর কথাবার্তা বলতেন, কারও সঙ্গে আপত্তিকর ছবি আদান-প্রদান করতেন, আবার কারও কাছ থেকে টাকাও দাবি করেন। এ ব্যাপারে ওসি মহসীন প্রথমে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরবর্তীতে চলতি মাসের ২২ তারিখ নিজেই বাদী হয়ে তেজগাঁও থানার সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন।
Advertisement
ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) গাইবান্ধা জেলার সদর থানার স্টেশন রোডের দাশ বেকারি মোড়ের ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশের একটি দল।
পুলিশ পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে দলের বাকি সদস্যরা হলেন-এসআই সালেকীন মিল্লাত তাওফিক, এএসআই সজল কুমার ম-ল ও মোশফিকুর রহমান।
ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নামেও ফেসবুক একাউন্ট খুলেছেন আনোয়ার। তার এই ভুয়া আইডির তালিকায় আছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার ১০ নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান, তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন, চিত্রনায়ক শান্ত খান, অভিনেতা ও মডেল আব্দুন নুর সজল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আইডি বর্তমানে ডিজএ্যাবল অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাকিগুলো সবই সচল আছে। এসব আইডি থেকে আনোয়ার ওই ব্যক্তি সেজেই বিভিন্ন পোস্ট, ছবি দেন। আর ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে চ্যাট করেন।
ওসি সেজে ৭৭১ মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করেন পঞ্চম শ্রেণি ফেল আনোয়ার!
আনোয়ার গাইবান্ধা সদরের খোলাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে ফেল করার পর আর চালিয়ে যাননি। কিন্তু এই আনোয়ারই মেয়েদের সঙ্গে চ্যাট করেন ওসি সেজে! তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনের নাম ও ছবি ব্যবহার করে তিনি একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন। মূল আইডি থেকে ছবি ও স্ট্যাটাস নিয়ে ভুয়া এই আইডিতে নিয়মিত পোস্ট করেন আনোয়ার। আর ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করেন।
এখন পর্যন্ত ৭৭১ জন মেয়ের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করেন আনোয়ার। শিক্ষার্থী, গৃহিণী, প্রবাসী, মডেল- সবাই আছেন এই তালিকায়। ম্যাসেঞ্জারে কথা বলার পরে হোয়াটসঅ্যাপেও তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কথা বললেও কারও সঙ্গে ভিডিও কলে আসতেন না তিনি। আবার কেউ দেখতে চাইলে কিংবা সন্দেহ করলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ব্লক করে দিতেন। তিনি মূলত মেয়েদের সঙ্গে আপত্তিকর কথাবার্তা বলতেন। এদের মধ্যে কারও কারও সঙ্গে ছবিও আদান প্রদান করেছেন। আবার কারও কারও কাছে টাকাও দাবি করেছেন।
Advertisement
নায়িকা হতে আনোয়ারের কাছে ধর্ণা!
চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার ১০ নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন আনোয়ার। ওই আইডিতে নিজেকে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে দাবি করেন তিনি। সেই পরিচয় দেখেই তার সঙ্গে বিভিন্ন মেয়ে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতেন। মূলত নায়িকা হওয়ার জন্যই তারা যোগাযোগ করতেন। ম্যাসেঞ্জারে সেলিম খান মনে করে আনোয়ারকে অনুরোধ করেন। আনোয়ারও এসব মেয়ের সরলতার সুযোগ নিতেন। তিনি নায়িকা বানাবে বলে তাদের ছবি পাঠাতে বলেন। যেসব মেয়ে সুন্দর আনোয়ার তাদের নায়িকা বানানোর আশ্বাস দিয়ে দিনের পর দিন কথা বলতেন। এক পর্যায়ে গিয়ে কোনো কোনো মেয়ে নিজেরাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিতেন। আর মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আনোয়ার নিজেই কোনো কোনো মেয়েকে ব্লক করে দিতেন। আর বাকিদের আরও স্লিম হতে হবে, স্মার্ট হতে হবে ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যেতেন।
প্রেসের কর্মচারী যখন চলচ্চিত্র নায়ক!
আনোয়ার চাকরি করেন ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে তিনি মেশিনের হেলপার হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু ফেসবুকে শত শত মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন চলচ্চিত্র নায়ক শান্ত খান এবং আব্দুন নুর সজল হিসেবে! এই দুই অভিনেতার নামেও ভুয়া আইডি খোলেন আনোয়ার। সেই আইডি থেকে বিভিন্ন মানুষের স্ট্যাটাসে কমেন্ট করতেন তিনি। আর ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করতেন। মেয়েরাও অভিনেতা শান্ত ও সজল মনে করে তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
ফেসবুক মাস্টার আনোয়ারের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আনোয়ার চাকরি করেন ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ফাঁকে ফাঁকে তিনি ইউটিউব দেখে দেখে ফেসবুকের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখেন। এভাবে শিখে শিখেই বিভিন্ন মানুষের ফেসবুকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেন। খোলাবাড়ি গ্রাম ও দাশ বেকারি মোড় এলাকায় তিনি ‘ফেসবুক মাস্টার’ নামেই পরিচিত।
আইডি, পাসওয়ার্ড হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করা, পেজ ভেরিফিকেশন, রিপোর্ট কিংবা স্ট্রাইক খাওয়া পেইজ রিকভারসহ ফেসবুকের যেকোনো সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে ওঠেন আনোয়ার।
Advertisement
যেভাবে মেয়েদের ফেসবুক আইডি, পাসওয়ার্ড নিজের করে নেন আনোয়ার!
কারও ফেসবুক আইডি, পাসওয়ার্ড হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করে দেন আনোয়ার। এজন্য তার কাছে বিভিন্ন মেয়েরা আইডি, পাসওয়ার্ড উদ্ধারেও যোগাযোগ করতেন। কিন্তু যেসব আইডি তিনি উদ্ধার করে দিতেন সেসব আইডিই আনোয়ারের হয়ে যেতো! আনোয়ার বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতেন। ফলে পরবর্তীতে ওই আইডি তার কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যেতো। পরে আনোয়ার সেই আইডিই ব্যবহার করতেন। এসবের মধ্যে যেসব একটু পুরাতন হয়েছে সেসবের নাম পরিবর্তন করেই গণ্যমান্য ব্যক্তির নামে ভুয়া আইডি খুলতেন। এসব আইডি রিপোর্ট করে বন্ধ করলেও কিছুদিন পর আবারও তা রিকভার করে ফেলেন আনোয়ার।