পর্যটন নগরীর রেল যোগাযোগের সাক্ষী হয়ে থাকা ৪৫ বছর বয়সী এই ট্রেনচালক তার স্বপ্ন ও সেদিনের স্মৃতি নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রাসেল মাহমুদ।
জাগো নিউজ: চট্টগ্রামে কীভাবে আসলেন, কেন আসলেন?
আব্দুল আওয়াল রানা: আমার বাবা (আব্দুল আজিজ) চট্টগ্রামে রেলওয়ের সরঞ্জাম বিভাগের সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবে চাকরি করতেন। টাঙ্গাইলে পানকাতা ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করার পর পরিবারসহ চট্টগ্রামে চলে আসি। এরপর চট্টগ্রামে বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি ও সরকারি সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করি। বাবার চাকরির সুবাদেই এখানে আসা।
জাগো নিউজ: শিক্ষাজীবনে আপনার জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? এই পেশায় কীভাবে আসলেন?
আব্দুল আওয়াল রানা: শৈশবে স্বপ্ন ছিল পাইলট হবো। তার জন্য পরীক্ষাও দিয়েছিলাম. কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হতে পারিনি। পরে পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর বাবা উৎসাহ দিতেন রেলওয়ের চাকরিতে আসার বিষয়ে। বাবার উৎসাহেই রেলওয়েতে সহকারী লোকোমাস্টার পদে আবেদন করি। ভালো পরীক্ষা দিয়ে টিকেও যাই। পরে ভাইভা শেষে ২০০৪ সালের শেষের দিকে এখানেই নিয়োগ পাই। এরপর দুই বছরের কঠিন প্রশিক্ষণ হয়। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে না পারলে চাকরিতে যোগদান করা যাবে না- সেই ভয়ও ছিল। সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে যোগ দিয়ে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে প্রায় ১০ বছর পর লোকোমাস্টার হই।
জাগো নিউজ: ট্রেন চালানোর প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা কেমন?
আব্দুল আওয়াল রানা: ২০১৪ সালে লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক) হিসেবে প্রথম ট্রেন চালাই। প্রথমে লোকাল ট্রেন চালাতে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হলে তারপর আন্তঃনগর ট্রেন চালাতে দেওয়া হয়।
জাগো নিউজ: প্রায় ১০ বছর ট্রেন চালানোর পর যেদিন কক্সবাজার এক্সপ্রেসের প্রথম চালক হিসেবে মনোনীত হলেন তখন অনুভূতি কেমন ছিল?
আব্দুল আওয়াল রানা: এত কর্মকর্তার মধ্যে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে- এটা ভেবে ভালোই লাগছিল। ঈদের আগের দিনে যেমন মনে আনন্দ থাকে, তেমনটাই অনুভূত হয়েছিল। একটা নতুন ট্রেন চালাবো, ভয়ও লেগেছে। কারণ, নতুন রুটে প্রথম কোনো ট্রেন চলবে, সেটা আমি সফলভাবে চালিয়ে যেতে পারবো কি না। সম্পূর্ণ অপরিচিত ও নতুন প্রায় ১৫০ কিলোমিটারের পথ আমি পাড়ি দেবো। পরিচিত পথে ট্রেন চালালে অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়।
Advertisement
নতুন ট্রেনের লোকোমাস্টার মনোনীত হওয়ার পরপরই বাবা-মাকে কল করে জানাই। বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। আমার স্ত্রীও খুশি হয়েছিল। দুই মেয়েও খুব খুশি হয়, তারা প্রথম দিনই ওই ট্রেনে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু রেলের (ঊর্ধ্বতন) সবাই যেহেতু থাকবে এবং ট্রেনটা প্রথম চালাবো, তাই তাদের নিতে পারিনি।
জাগো নিউজ: ট্রেনটির প্রথম যাত্রা শুরুর অনুভূতি কেমন ছিল?
আব্দুল আওয়াল রানা: আমার প্রথম সন্তান যখন জন্ম হয় তখন যেই ধরনের অস্থিরতা ছিল, কক্সবাজার এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন চালুর পর রেললাইনে চলতে শুরু করলে এমন অনুভূতি কাজ করে। হুইসেল দিয়ে যখন ট্রেন চালাতে শুরু করলাম, তখন মানুষের যেই উৎসাহ দেখলাম- তা বলে বোঝানো যাবে না। তখন মনে হয়েছে আমি একটা ট্রেনকে নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
জাগো নিউজ: নতুন এই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হলে মানুষের উচ্ছ্বাস কেমন দেখলেন?
আব্দুল আওয়াল রানা: করোনার সময় বেশ কয়েক মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। তাতেই মনে হয়েছে কিছু একটা চলে গেছে। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে সেসময় যেদিন ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়, সেদিন রেললাইনের দুপাশে মানুষ হাত নাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। আর কক্সবাজারের মানুষতো তাদের এলাকায় আগে কখনো কোনো ট্রেন দেখেননি। ফলে এটা যে তাদের জন্য কতটা আনন্দের, কতটা উচ্ছ্বাসের তা সেদিন দেখা গিয়েছিল। বাড়ি থেকে ছোট-বড়রা এমনকি লাঠি ভর দিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও রেললাইনের পাশে এসে হাত নাড়িয়ে স্বাগত জানান। এর থেকে ভালো লাগা আর কী থাকতে পারে। এগুলো দেখে আমি রেললাইনে তাকাবো, নাকি তাদের উচ্ছ্বাস দেখবো- সেটা ছিল অনেক আনন্দের।
জাগো নিউজ: নতুন রুটে চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
আব্দুল আওয়াল রানা: আমাদের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করে, আমাকে সময় মেপে ট্রেনটা চালাতে হবে। যেই সময়টা নির্ধারণ করে দিয়েছে তার মধ্যেই আমাকে যেতে হবে। সময় নির্ধারণ করে চলাটাই নতুন রুটে আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ প্রথম যাত্রায় রেলওয়ের কর্মকর্তারা, যাত্রীরা সবাই দেখবেন কত সময় লাগছে।
জাগো নিউজ: নতুন এই রেললাইন কেমন লেগেছে?
আব্দুল আওয়াল রানা: চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় হাতি চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। ওই এলাকায় যখন ট্রেন পৌঁছায় তখন আমি হাতি খুঁজেছি, যদিও সেদিন হাতির দেখা পাইনি। এছাড়া ছোট ছোট বাড়ি থেকে বাচ্চারা, বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড় দেখে ভালো লাগে। পাহাড়ি লাল মাটি কেটে রেললাইন করা হয়েছে, সেটাও এক অন্যরকম সুন্দর।
জাগো নিউজ: কক্সবাজার-ঢাকা রুটের ট্রেনের প্রথম চালক হয়ে কেমন লাগছে?
আব্দুল আওয়াল রানা: আমার দুই মেয়েকেই এখন তাদের বন্ধুদের কাছে এই পথে ট্রেন চালানোর গল্প বলতে হয়। আমার বন্ধুরাও বেশ খুশি। অনেকেই বলেন- ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলে! এগুলো শুনলে আসলেই বেশ ভালো লাগে। যখন অবসরে যাবো আর ট্রেনে করে নাতি-নাতনিদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যাবো, তখন বলতে পারবো- এখানের প্রথম ট্রেনটি আমি চালিয়ে নিয়ে আসছিলাম।
‘বাংলাদেশের রেলপথ ও স্টেশনগুলোতো স্বাধীনতার আগেই করা। তাই নতুন একটা স্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল করছে- সেটাই এক ধরনের ভালো লাগা। আমার নাতি-নাতনিদেরও ভালো লাগবে যে তারা বলতে পারবে, আমার নানা-দাদা এখানে প্রথম ট্রেন চালিয়েছেন।’
জাগো নিউজ: রেলপথ নিয়ে আপনার চাওয়া কী?
আব্দুল আওয়াল রানা: আমাদের চাকরির বিষয়টি আগে অনেকটা লুকিয়ে থাকার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু এখন বেশ পরিবর্তন হয়েছে। সবাই সম্মান করে। রেলে অনেক কাজ হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় এই সম্পদের রক্ষা শুধু রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই করবে না, সাধারণ জনগণকেও করতে হবে। রেলগাড়িতে বাচ্চারা যেন পাথর নিক্ষেপ না করে। সবার মধ্যে যেন এই সচেতনতাটা তৈরি হয় এবং পাথর নিক্ষেপ পুরোপুরি বন্ধ হয়।
Advertisement
জাগো নিউজ: ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
আব্দুল আওয়াল রানা: আপনাদেরও ধন্যবাদ।