যেভাবে ইউটিউবে ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে

SHARE

য়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি), প্রযুক্তি ও গবেষণা প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩ : বিজ্ঞানসম্মত কনটেন্টের আড়ালে ইউটিউবে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ২০টিরও বেশি ভাষায় এরকম ভিডিও দেখা গেছে। অনেক ইউটিউব চ্যানেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভিডিও বানায়। তাদের ভিডিওতে বিজ্ঞানের মিথ্য তথ্য খুঁজে পেয়েছে বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম।

Advertisement

তারা বলছে, ২০টির বেশি ভাষায় ৫০টিরও ওপর ইউটিউব চ্যানেল শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলো বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ক কনটেন্ট বানায়। কিন্তু এসবের আড়ালে তারা গুজব ছড়াচ্ছে। সেগুলোতে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও রয়েছে। যেমন- পিরামিড থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন, মানুষের দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অস্বীকার এবং এলিয়েনের অস্তিত্ব নিয়ে কনটেন্ট।
বাচ্চাদের জন্য তথাকথিত নানা শিক্ষামূলক ভিডিও বানাচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলগুলো। ইউটিউবার ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষক কাইল হিলের অসংখ্য তরুণ অনুসারী আছে। কয়েক মাস আগে হঠাৎ লক্ষ্য করেন এসব ভুল বিজ্ঞানের ভিডিও তার ইউটিউব ফিডেও আসছে। তিনি জানান, অনুসারীরাই যোগাযোগ করে জানায় এই ‘রেকমন্ডেড’ কনটেন্টগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও আসলে ভুল তথ্যে ভরা। একই বিষয়ে করা কোনও মূল ভিডিওর অংশ চুরি করে এবং সেখানকার তথ্যের খানিক পরিবর্তন করে নিজেদের সাইটে তুলে দিচ্ছে অনেক চ্যানেল।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ভিডিওতে আজগুবি সব দাবি করা হয়। সেই সঙ্গে থাকে চাঞ্চল্যকর বর্ণনা এবং নজরকাড়া শিরোনাম। নাটকীয় ছবি ব্যবহার করে দর্শককে আকর্ষণ করা হয়। কারণ, যত বেশি ভিডিওটি দেখা হবে, চ্যানেলটি বিজ্ঞাপন থেকে তত অর্থ উপার্জন করবে। একইসঙ্গে ইউটিউবেরও লাভ। কারণ বিজ্ঞাপনের ৪৫ শতাংশ অর্থ তারা পায়।

কাইল হিল বলেন, আমি একজন বিজ্ঞানের লোক। তাই এটা ব্যক্তিগতভাবে নেই। কারণ, চ্যানেলগুলো খুব অল্প পরিশ্রমে কীভাবে সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া যায়; সেই ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।

বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম জানায়, বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য চ্যানেল ইউটিউবে এই ধরনের ভিডিও তৈরি করছে। যার মধ্যে আছে আরবি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ ও থাই। এর মধ্যে অনেক চ্যানেলেরই মিলিয়নের ওপর সাবস্ক্রাইবার। তাদের ভিডিওর ভিউও প্রায়ই মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এসব কনটেন্ট ক্রিয়েটররা খুব দ্রুত ভিডিও প্রকাশ করে। কেউ কেউ একই দিনে একাধিক ভিডিও পোস্ট করছে।

Advertisement

তারা বলছে, এত দ্রুততার সঙ্গে ভিডিও প্রকাশ দেখে সন্দেহ হয় কোন এআই টুল বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামের সাহায্য নিচ্ছে তারা। প্রোগ্রামগুলো চ্যাটজিপিটির মতোই। সেগুলোকে বললেই নতুন কনটেন্ট বানিয়ে দেয়। যেমন-একটা কালো বিড়াল মুকুট পড়ে আছে। এজন্য ইন্টারনেট সার্চ করে ওরকম কিছু খুঁজতে হয় না। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রতিটি চ্যানেল থেকে ভিডিও নেয়া হয়। এরপর এআই শনাক্তকারী টুল ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। পরে বোঝা যায়, এগুলোর ছবি, ধারা-বর্ণনা ও স্ক্রিপ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে নেয়া।

বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সেগুলো ওই বিষয়ে কোনও সত্যিকারের বিজ্ঞান ভিডিও থেকে কেটে নেয়া বা কারচুপি করা। এই কনটেন্টগুলো মনে হবে বস্তুনিষ্ঠ। কিন্তু আসলে বেশিরভাগই অসত্য। এসব ভুল বিজ্ঞানের ভিডিও বাচ্চাদের কাছে ইউটিউব রেকমেন্ড বা সুপারিশ করে। ইউটিউবের প্রধান সাইটেই কিছু বাচ্চাদের অ্যাকাউন্ট খুলে এটা দেখা যায়।

বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম জানায়, ৪ দিন ধরে বিজ্ঞানবিষয়ক কিছু শিক্ষামূলক ভিডিও দেখার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিডিওগুলো সাজেশন হিসেবে আসতে থাকে। আর এগুলোতে ক্লিক করলে রেকমেন্ড হতে থাকে। এর কিছু কনটেন্ট ১০ থেকে ১২ বছর বয়সীদের মধ্যে দুটি আলাদা দল করে দেখাই। যার একটা যুক্তরাজ্যে, আরেকটা থাইল্যান্ডে।

উল্লেখ্য, একটি ভিডিও আকাশে দেখতে পাওয়া রহস্যময় বস্তু যেগুলোকে ইউএফও বলা হয় এবং এলিয়নের অস্তিত্ব নিয়ে। আরেকটি গির্জার পিরামিড বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হতো- এমন মিথ্যা দাবির ওপর ভিত্তি করে। বাচ্চারা এসব ভিডিও দেখে বিশ্বাস করে।

এক দর্শকশ্রোতা বলেন, ভিডিও দেখতে মজা লেগেছে। একটা মেয়ে বলে, আগে আমি এলিয়েনের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু এখন আমার মনে হয় তারা আসলে আছে। আরেক বাচ্চা ইলেকট্রিক পিরামিডের বিষয়টা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত। সে বলে, আমি জানতাম না যে এত আগেও মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারতো।

তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে ভিডিওগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি। এক দর্শকশ্রোতা বলেন, আমার কাছে তো খুব হাস্যকর লেগেছে। তারা একটা মানুষের কণ্ঠস্বরও ব্যবহার করেনি। আমার তো মনে হয় না এটা মানুষের গলা ছিল।

বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিমের ভাষ্যমতে, পরে বাচ্চাদের কাছে ব্যাখা করা হয়, এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি। এসবের মধ্যে মিথ্যা তথ্য আছে। তখন তারা খুবই অবাক হয়। এক ছেলে বলে, “আমি তো আসলে এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম এসব সত্যি। আরেকজন বলে, এগুলো যে ভুয়া এটা না জানালে তো আমি সবই বিশ্বাস করে নিতাম।

Advertisement

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাচ্চাদের নতুন ও জটিল জিনিস জানার আগ্রহ আছে। সেটা নিয়ে খেললে তারা সত্য-মিথ্যা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ভিকি ন্যাশ মনে করেন, এই ভিডিওগুলো ভালো করে। কারণ এগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নির্ভর। যেকোনও জানা জিনিসের বিপরীতে যখন কিছু বলা হয়, সেটাতে আগ্রহ বোধ করি আমরা। আর বাচ্চারা বড়দের চেয়ে এসব ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রভাবিত হয়।

যুক্তরাজ্যের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ক্লেয়ার সিলেও এই ব্যাপারে একমত। তিনি বলেন, বাচ্চারা সাধারণত চোখের সামনে যেটা আগে দেখে সেটাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে ধরে নেয়। এরপর যখন তাদের খানিকটা বয়স হয়, তখনই তারা কেবল এটা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে।

এসব ভিডিও থেকে প্ল্যাটফর্মগুলোর টাকা কামানো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন প্রফেসর ন্যাশ। তিনি বলেন, ভুল বিজ্ঞানের ভিডিওর বিজ্ঞাপন থেকে ইউটিউব ও গুগল অর্থ আয় করছে। এই পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়।

বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিমের ব্যাখ্যায়, ইতোমধ্যে বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা এআই কনটেন্ট তৈরি করে। একজন জানান, তাদের কনটেন্ট শুধু ‘বিনোদনের জন্য’ বানানো। বাচ্চাদের লক্ষ্য করে কিছু করার বিষয়টা তারা অস্বীকার করেন। একই সঙ্গে জানান, তাদের স্ক্রিপ্টের বেশিরভাগে অংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য ছাড়ায় করা হয়েছে।

ইউটিউব জানায়, অনূর্ধ্ব ১৩ বছরের জন্য ইউটিউব কিডস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকে তারা। যেখানে কোনও ভিডিও দেখানো যাবে আর কোনটি যাবে না সে ব্যাপারে কড়াকড়ি আছে। নিজেদের প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা তথ্য সরানোর ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর তারা। পরিবারগুলোকে ‘নিরাপদ ও উচ্চমাত্রার ভিডিও অভিজ্ঞতা’ দিতে চায়। তবে এসব ভিডিওর বিজ্ঞাপনের রেভিনিউ থেকে অর্থ আয় করে কি-না, সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি প্ল্যাটফর্মটি।

এআই টুলগুলো দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। এসব দিয়ে কনটেন্ট বানানোও আরও সহজ হচ্ছে। এগুলো শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সিলি। তিনি মনে করেন, শিক্ষক ও বাবা-মায়েদের এই নতুন হুমকির ব্যাপারে প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের এখনো আসলে পরিষ্কার ধারণা নেই, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কনটেন্ট বাচ্চাদের বোঝাপড়ায় প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এগুলোর মুখোমুখি হওয়ার।