চিত্রা হরিণ প্রায় সারাবছরই প্রজননের জন্য প্রস্তুত থাকে। এদের গর্ভধারণকাল ২২৫-২৩৫ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা সচরাচর একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে কালেভদ্রে দুটি বাচ্চাও প্রসব করে। সংখ্যায় হ্রাস পেলেও এখন অবধি প্রচুর সংখ্যায় এ হরিণ আছে।
হরিণের দাম কত?
সব জায়গা থেকে হরিণ কেনা যায় না। আপনাকে হরিণ কিনতে হলে অনুমোদিত চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক থেকে কিনতে হবে।
ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, একটি হরিণের দাম ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এতে প্রতি জোড়া হরিণ তারা এক থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। এখনও তাদের কাছে ধারণক্ষমতার চেয়ে অন্তত ১০০টি হরিণ বেশি রয়েছে।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২১টি চিত্রা হরিণ বিক্রি করেছিল তারা। ২০১৭ সালে দুটি, ২০১৮ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ৪টি, ২০২০ সালে ৮টি, ২০২১ সালে ৫১টি এবং ২০২২ সালে ১৯৮টি। যা কিনা গত ছয় বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬৯টি হরিণ বিক্রি হয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে অবৈধভাবে হরিণ পোষার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ২০০৯ সালে দেশে প্রথম বাসাবাড়ি ও খামারে হরিণ লালন-পালনের অনুমতি দিয়ে একটি নীতিমালা জারি করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়।
Advertisement
যা রয়েছে বিধিমালায়
খামার পর্যায়ে হরিণ লালন-পালন করতে নিজস্ব মালিকানায়, ভাড়া বা দীর্ঘমেয়াদি ইজারা মূল্যে জমি থাকতে হবে। বন বিভাগ আবেদনের ৩৭ দিনের মধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে হরিণ পালনে উপযুক্ত কি না সেই প্রতিবেদন দাখিল করে। সিটি করপোরেশন পর্যায়ে লাইসেন্স ফি ২০ হাজার টাকা এবং এর বাইরে ১০ হাজার টাকা। লাইসেন্সের প্রসেসিং ফি দুই হাজার টাকা। এক বছর মেয়াদি লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২৫ শতাংশ ফি দিয়ে নবায়ন করতে হয়। মেয়াদ উত্তীর্ণের দুই মাসের মধ্যে নবায়নের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ এবং তিন মাসের মধ্যে করলে ফি ৮০ শতাংশ দিতে হয়।
একই সঙ্গে বছরে প্রতিটি হরিণের জন্য এক হাজার টাকা পজেশন ফি দিতে হয় বন বিভাগকে। লাইসেন্স পেয়ে এক মাসের মধ্যে পজেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। লাইসেন্স ও পজেশন সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি ফি এক হাজার টাকা।
তবে শৌখিন পর্যায়ের হরিণ পালনকারীদের লাইসেন্স নিতে হবে না। শুধু পজেশন সার্টিফিকেটের জন্য এক হাজার টাকা এবং প্রতিটি হরিণের জন্য বছরে এক হাজার টাকা পজেশন ফি দিতে হবে।
হরিণকে ছাগলের মতোই শেডের মধ্যে রাখা যায়। কেবল দানাদার খাবার, খনিজ লবণ ও সুপেয় পানির জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
২০০৯ সালের হরিণ লালন-পালন সংক্রান্ত নীতিমালায় চিত্রা হরিণ পূর্ণবয়স্ক হলে তার মাংস খাওয়ার অনুমতি ছিল। নতুন বিধিমালায় বলা হয়েছে, হরিণের মাংস খাওয়া যাবে না। এই বিধিমালা লঙ্ঘন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের ‘হরিণ ও হাতি লালন-পালন বিধিমালা ২০১৭’ অনুযায়ী, ১০টির বেশি হরিণ পালন করলে তা খামার হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তবে যে পর্যায়েই লালন-পালন করা হোক না কেন, হরিণের মাংস খাওয়া এখনো বৈধ নয়।
নিয়মানুযায়ী দুটি হরিণ রাখার জন্য অন্তত ১০ শতক ফাঁকা জায়গা থাকতে হয়। যে এলাকায় খামার তৈরি করা হবে, সেই এলাকার বন কর্মকর্তার কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে। খামার মালিকের নিজের, ভাড়ায় বা সরকারি জমির দীর্ঘমেয়াদি দখল থাকতে হবে।
খামারে প্রতিটি হরিণের জন্য অন্তত ১০০ বর্গফুট আয়তন এবং ১০ ফুট উঁচু শেড থাকতে হবে। সেখানে দানাদার খাবার, খনিজ লবণ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। খামারের চারদিকে ১০ ফুট উঁচু নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকতে হবে।
বন্য প্রাণী পালতে গেলে বন বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। মূলত যাদের কাছে সেই অনুমোদনপত্র বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট থাকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের কাছেই প্রাণীগুলো বিক্রি করতে পারে।
এই প্রাণীগুলো শুধু লালন-পালনের জন্য দেয়া হবে। এ ধরনের প্রাণী কোনো অবস্থাতেই পাচার, শিকার বা খাওয়া যাবে না। হরিণের সংখ্যা বেড়ে গেলে, বিক্রি করার প্রয়োজন হলে বা পজেশন সার্টিফিকেট বাতিল হলে বন কর্মকর্তার লিখিত অনুমতিতে হরিণ বা হাতি বিক্রি, বিনিময় বা দান করতে পারবেন। তবে যার কাছে হরিণ হস্তান্তর করা হবে, তারও হরিণ পালনের লাইসেন্স বা অনুমতি থাকতে হবে।
হরিণ কেনার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে বন অধিদফতরের পরিদর্শক দল সরেজমিন যাচাই করে দেখে যে, যিনি কিনবেন, তার সেগুলো লালন-পালন করার সামর্থ্য আছে কি না। প্রাণীগুলো বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার দেয়া ও পরিচর্যার সুব্যবস্থা এবং রোগবালাইয়ের থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার মতো জ্ঞান আছে নিশ্চিত হলেই তাদের অনুমোদন দেয়া হয়।
সেইসঙ্গে প্রাণীগুলো ঠিকমতো দেখভাল হচ্ছে কিনা সেটাও বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়মিত মনিটর করেন। সাধারণত তারা এসব প্রাণী লালন-পালনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। স্থানীয় পশু হাসপাতালকেও যেকোনো সহযোগিতার জন্যে এ তথ্য জানিয়ে রাখা হয়।
এক যুগ আগেও পার্ক কিংবা চিড়িয়াখানা ছাড়া শৌখিন ও খামার পর্যায়ে হরিণ পালনের কথা তেমন শোনা যায়নি। কিন্তু সরকারের বিধিমালা মেনে এখন অনেকে হরিণ পুষছেন।
বনের চিত্রা হরিণ ঘরে ও খামারে পোষা শুরু হয় সেই ২০১৭ সাল থেকেই। তবে এ জন্য পালনকারীকে হরিণের বসবাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ জন্য একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে। এতে বন বিভাগকে হরিণ পোষার অনুমতির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং এর জন্য ফি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। অনেক বছর থেকেই বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন বন অফিস থেকে হরিণ পোষার অনুমোদন দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইন (সংরক্ষণ, সংশোধন), ১৯৭৪-এর আওতায় চিত্রল হরিণ পোষাসংক্রান্ত নীতিমালা-২০০৯ অনুমোদন করেছে সরকার। তবে চিত্রা ছাড়া অন্য কোনো হরিণ পোষা যাবে না। কেউ অন্য হরিণ পুষলে তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগে বন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় হরিণ লালন-পালনের অনুমোদন দিত। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিতে হতো। এই নতুন নীতিমালায় চিত্রল হরিণ লালন-পালন ও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে।
খামারের হরিণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বন সংরক্ষক ও ব্যক্তিগত হরিণের ক্ষেত্রে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে হবে। হরিণ বাচ্চা প্রসব করলে বা মারা গেলে ঘটনা ঘটার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের কাছে তা জানাতে হবে। হরিণের মাংস বা কোনো অঙ্গ স্থানান্তর করতে হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে স্থানান্তর অনুমোদন নিতে হবে। কাউকে হরিণ দান করতে হলেও বন বিভাগকে অবহিত করতে হবে।
কী বলছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা?
বাংলাদেশের বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমতি নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বাসিন্দারা কয়েক রকমের বন্যপ্রাণী পালন করতে পারেন। এর মধ্যে হরিণ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, হাতি, হরিণ, কুমির আর ময়ূর, এই চারটি প্রাণী পালন করার জন্য আমরা অনুমতি দিয়ে থাকি। সবচেয়ে বেশি সাড়া পাই হরিণের ক্ষেত্রে। এর বাইরে আর কোন বন্যপ্রাণী খাঁচায় বা আটকে রেখে পালন করলে সেটা পুরোপুরি অবৈধ বলে গণ্য হবে।
তবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সাধারণ মানুষের কাছে চিড়িয়াখানার প্রাণী বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এতে করে বন্যপ্রাণী নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন,
সাধারণ মানুষের কাছে বন্যপ্রাণী বিক্রি করা হলে প্রাণীগুলোর সঠিক পরিচর্যা, প্রজনন ও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা কঠিন। আমরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে বলেছি। কিন্তু, সেটি কেউ নজরে নেয়নি। এটা আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
তিনি আরও বলেন, ‘চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রাণী বিক্রি করার কোনো অধিকার নেই। সেখানে প্রাণীর সংখ্যা যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে তারা অন্য কোনো চিড়িয়াখানার সঙ্গে সেগুলো বিনিময় করতে পারে।’
‘তা ছাড়া, যে প্রাণীগুলো বিক্রি করা হয়, সেগুলোর পরবর্তীতে কী হয়, সেটা সঠিকভাবে নজরদারি করা হয় না। প্রাণীগুলোর নতুন বাচ্চা হলে সেগুলোর প্রত্যেকটার খুঁটিনাটি সব তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু, সেটি কি করা হয়?’, বলেন তিনি।
Advertisement
এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন,
যারা প্রাণীগুলো লালন-পালনে সক্ষম, জায়গা ও আর্থিক সঙ্গতি আছে, তাদেরকেই এসব প্রাণী লালন-পালনের অনুমোদন দেয়া হয়। আবেদন পাওয়ার পর আমরা সরেজমিনে দেখে সব ঠিকঠাক পেলে প্রাণী কেনার অনুমোদন দিয়ে থাকি। এখানে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা অন্য কোনো বিষয় নেই।
পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, ঢালাওভাবে হরিণ পালনের অনুমতি দিলে এর অপব্যবহার হতে পারে। বন্য হরিণ আরও বিপন্ন হতে পারে।