দাদি হালিমা খাতুনের চোখে জল, মনে আতঙ্ক। কথা বলছেন নিচু স্বরে। যদি তার এই প্রতিবাদের সুর জেনে যায় সন্ত্রাসীরা। তাহলে হয়তো ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির মতো তাকেও গ্রাম ছাড়া হতে হবে। এ কারণে আদরের নাতনির বই হাতে বিছানার উপর নীরবে কাঁদছেন। আজ তার এসএসসি পরীক্ষা।
দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হয়েও প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে সে। কিন্তু সুন্দর চেহারা, শারীরিক গঠনই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বেঁচে থাকার জন্য। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে চায় তাকে। সে কারণে পরীক্ষার আগে টানা ১৫দিন ধরে পরিবারের সদস্যরা গ্রামছাড়া।
বগুড়া শহরের অদূরে গোকুল মধ্যপাড়া এলাকায় গত তিন সপ্তাহ ধরে এমন ভীতিকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন যুবলীগ কর্মী আতিকুর রহমান ওরফে আকুল এবং রাব্বি মিয়া নামে দুই সন্ত্রাসী। আকুল-রাব্বি বাহিনীর ভয়ে এলাকা ছাড়া দুই অসহায় পরিবারের চার স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে দুজনই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়িতে না ফেরায় কিশোরীসহ দু`জনের আজ থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বগুড়ার গোকুল ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, এলাকার বখাটে দুই সন্ত্রাসী স্কুল-পড়ুয়া কিশোরী দুই কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল তাদের গরিব বাবা-মায়ের কাছে। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় একদিন পর সন্ত্রাসীরা সদলবলে অস্ত্রের মুখে তুলে আনতে যায় ওই দুই কিশোরীকে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে এক পরিবার তিন সপ্তাহ আগে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপন করেছে। অন্য পরিবার সন্ত্রাসীদের ভয়ে স্কুল-পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়েছে বহু দূরে নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে।
দুই কিশোরীকে তুলে নিতে না পেরে এক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ তাণ্ডব চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। দিনেদুপুরে গোয়াল থেকে নিয়ে গেছে বলদ। জিম্মি করে রেখেছে আরও তিনটি পরিবারকে। সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি পরিবারে এখন অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন যুবলীগের কর্মী আতিকুর রহমান ওরফে আকুল। যুবলীগের ছত্রছায়ায় তিনি সেখানে একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তবে তার বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই বিএনপির কর্মী এবং গতবছরের অবরোধ-হরতালে গাড়ি পোড়ানো ও নাশকতার মামলার আসামি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মহাস্থানগড় ও গোকুল বন্দরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদাবাজি তার প্রধান পেশা। এরপর এই বাহিনীর নজর পড়ে গোকুল মধ্যপাড়ার গাড়িচালক মো. জিন্না মিয়ার এসএসসি পরীক্ষা কন্যা এবং তার ভাগ্নি পাশের বাড়ির মুদি দোকানি বাবলু মিয়ার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী কন্যার প্রতি। জিন্নার মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে চায় আকুল, আর বাবলুর মেয়েকে বিয়ে করতে চায় রাব্বি।
রোববার গোকুল মধ্যপাড়ায় জিন্না মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, গোটা বাড়িজুড়ে সুনসান নীরবতা। শোবার ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে। বাড়ির অন্যপাশের ঘরগুলোতে ভাই ও বৃদ্ধা মা অবস্থান করলেও তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক।
জিন্না মিয়ার বৃদ্ধা মা হালিমা বেগম বলেন, ১৫ দিন ধরে চলছে এই তাণ্ডব। পুলিশকে জানানো হলেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। এরই মদ্যে একদিন আকুল ও রাব্বির নেতৃত্বে ১৫/২০ জন সন্ত্রাসী বাড়িতে হামলা করে। তারা অস্ত্র হাতে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, খরের গাদায় আগুন জ্বালানো ছাড়াও গোয়াল থেকে গরু বের করে নিয়ে যায়। বলে গেছে নাতনিকে বিয়ে না দিলে স্বপরিবারে জ্বালিয়ে মারবে।
গাড়িচালক জিন্না মিয়া মোবাইলে জানান, সন্ত্রাসী আকুল কিছুদিন আগে তার কিশোরী কন্যাকে বিয়ে করার কথা বলেন। অন্যদিকে তার সহযোগী রাব্বি তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাগ্নিকে বিয়ে করতে চান। এতে রাজি না হলে গত ৯ জানুয়ারি রাতে সন্ত্রাসীরা প্রথমে তার বাড়িতে চড়াও হয়ে ইটপাটকেল মারে। পরের রাতে কন্যাকে তুলে নিতে সন্ধ্যায় বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় কিশোরী কন্যাকে নিয়ে স্ত্রী কোনো রকমে আত্মগোপন করে রক্ষা পান। এরপর তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন। সন্ত্রাসীরা তার মা-ভাই ও বোনের তিনটি পরিবারকে জিম্মি করে রেখেছে।
মুদি দোকানি বাবলু মিয়া জানান, তার শিশু কন্যার সঙ্গে একমাত্র ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী এখন পলাতক রয়েছে। সন্ত্রাসীরা বোনকে না পেয়ে তার উপরেও চড়াও হয়েছিল। এ কারনে তার পরীক্ষা দেয়াও এখনো অনিশ্চিত।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি তিনি রোববার দুপুরে জেনেছেন। এরপর সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি বলেন, এলাকা ছাড়া পরিবারকে বাড়িতে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। থানা পুলিশের কোনো প্রকার গাফিলাতি থেকে থাকলে তারও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে আকুল বাহিনীর প্রধান আকুল জানান, আমি হামলা করেছি এটি সত্য। এর কারণ ওই মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেয়ার কথা ছিলো। এখন তার পরিবার সেই ওয়াদা ভুলে গেছে। এ কারণে আমি জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছি। তিনি স্বীকার করেন যে, আগে তিনি নিজেও আগে বিএনপির রাজনীতি করতেন। এখন যুবলীগ করেন। গোকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
বগুড়া জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল বারী ডাবলু জানান, ঘটনাটি তার নজরে আসার পর তিনি নিজেও পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন। আর আকুল যুবলীগ পরিচয় দিলেন এখন তাদের দলে নেই। চাঁদাবাজির একটি অভিযোগে সম্প্রতি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।