ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,সোমবার, ০৬ নভেম্বর নভেম্বর ২০২৩ : ১৩ জনের পরিচালনা কমিটির সাতটি পদই শূন্য। তবে পদগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে শূন্য ঘোষণা করেনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অর্ধেকের বেশি সদস্য না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই বিদ্যালয় থেকেই ৩০৪ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা সম্প্রতি তদন্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)।
বিদ্যালয়ে সম্প্রতি অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ এ নিয়ে পরিচালনা কমিটিকে উকিল নোটিশ দিয়েছেন। আংশিক পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ নয় উল্লেখ করে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
Advertisement
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। গভর্নিং বডির সভাপতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি এই স্কুলের বিষয়ে দীর্ঘদিন থেকেই গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন।
পরিচালনা কমিটির মাধ্যমিক শাখার অভিভাবক সদস্য মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। টিপু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে এ স্কুলের অভিভাবক সদস্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার কারাগারে। একই কমিটির আরেকজন অভিভাবক প্রতিনিধি সোহেল আহম্মেদ সিদ্দিকী গত বছরের ৮ মে মারা যান।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক প্রতিনিধি রোকনুজ্জামান শেখ গত ১২ মার্চ আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। নিয়ম অনুযায়ী কমিটিতে তাঁর সদস্য পদ আর নেই। একই কমিটির দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে করেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিভাবকের পক্ষ থেকে ধর্ষণ মামলা দায়ের ও হাইকোর্টের ভর্ৎসনার পর গত জুলাই মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। স্কুলের অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশেদীও একই মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করেছেন।
আইডিয়াল স্কুলের পরিচালনা কমিটির সংরক্ষিত মহিলা শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন মাকসুদা আক্তার মালা। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে তিনিও কারাগারে। পরিচালনা কমিটিতে কলেজ শাখার শিক্ষক প্রতিনিধি মিজানুর রহমান গত ২১ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। তাই তাঁর শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য পদ শূন্য হয়ে গেছে।
বর্তমানে যে ছয়জন কমিটিতে রয়েছেন, তারা হলেন– গভর্নিং বডির সভাপতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. শহীদুল ইসলাম, মাধ্যমিক শাখার অভিভাবক সদস্য অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন, সংরক্ষিত অভিভাবক মহিলা সদস্য আজিজা বেগম, প্রাথমিক শাখার অভিভাবক সদস্য মো. শাহাদাত ঢালী মেহেদী এবং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান।
বিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান গভর্নিং বডির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৯ নভেম্বর। গত ২০ অক্টোবর গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন ক্যাটেগারিতে ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ না থাকায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ নির্বাচন বাতিল করে। ফলে নির্বাচিত কমিটির বদলে এ প্রতিষ্ঠানটি আবারও গুটি কয়েক ব্যক্তি দ্বারা অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার দিকে ফের এগোচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা।
Advertisement
তারা জানান, শিক্ষার মানোন্নয়নে এই গভর্নিং বডি গত দুই বছরে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অভিভাবকদের কাছে দৃশ্যমান নয়। বরং পরিচালনা কমিটির কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়মের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে সরকারি তদন্তে। অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শত শত শিক্ষক-কর্মচারী। নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকের মধ্যে জাল সনদধারীও রয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০৪ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সে সময়ে খরচ দেখানো হয়েছে ৬৪ লাখ টাকার বেশি। অনিয়মের মাধ্যমে খরচ করা অর্থ ও বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারের কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মুগদা শাখায় বিধি লঙ্ঘন করে হাতে রেখে খরচ করা হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার বেশি। এই অনিয়মের কারণেও প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মতিঝিল শাখায় ২০১১ সালে ১১১ জন শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগের রেকর্ডে অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি উল্লেখ করে তা বাতিলের পাশাপাশি তাদের গৃহীত বেতন-ভাতা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলেছে তদন্ত কমিটি।
ডিআইএর প্রতিবেদন দেখা গেছে, গভর্নিং বডির সভায় সদস্যদের সিটিং অ্যালাউন্স (সম্মানী) দেওয়া হয়। বড় অঙ্কের আপ্যায়ন গ্রহণ, কন্টিজেন্সি, গভর্নিং বডির সদস্যদের ব্লেজার কেনা ও সম্মানী বাবদ খরচ করা হয়েছে। গভর্নিং বডির সদস্যরা প্রতিটি শাখা থেকে এ ধরনের খরচ নিয়েছেন, যা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ বেড়েছে। ব্লেজার কেনার জন্য বর্তমান কমিটি সভাপতি ও সদস্যরা সম্মানী নিয়েছেন ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আবার স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করলেও সে বাবদ সম্মানী নিয়েছেন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সমকালকে বলেন, দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচাতে খ্যাতনামা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা প্রয়োজন। গভর্নিং বডি ও অধ্যক্ষ সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। দোষীদের কোনো শাস্তিই দেওয়া হচ্ছে না।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক এবং তদন্ত দলের প্রধান বিপুল চন্দ্র সরকার সমকালকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি টাকার অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগেও অনিয়ম হয়েছে।
Advertisement
জানা যায়, অধ্যক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জন্য যে রেজ্যুলেশন করা হয়েছিল, তা যথাযথ হয়নি। কারণ, কোরাম সংকট নিয়ে গভর্নিং বডির যে কোনো সিদ্ধান্তই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধিমালা অনুসারে অগ্রহণযোগ্য। কোরামের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে সাতজন সদস্য। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডির বর্তমান সদস্য মাত্র ছয়জন। আবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অন্তত তিনজনের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। নিয়োগ কমিটিতে মাউশি ডিজির প্রতিনিধি হিসেবে থাকা ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ এই প্রার্থীদের নিয়োগে বিরোধিতা করেন। তিনি সমকালকে বলেন, আবেদন করা কোনো প্রার্থীই ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো যোগ্য নন। তাই তাদের কাউকেই নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা গেল না।