ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি ,রোববার,২৭ আগস্ট ২০২৩ : রাজধানীর কল্যাণপুরে দীর্ঘদিন একা বাস করতেন জাহানারা সাথী (৪০) নামে এক নারী। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাঁর আর খোঁজ নেই। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর থানায় নিখোঁজ জিডি করেন তাঁর স্বজন।
Advertisement
সাধারণ ডায়েরি নম্বর ১০২৫। জিডিতে বলা হয়েছিল– বন্ধ ছিল মোবাইল নম্বর। এরপর স্বজন ও পরিচিতরা ফেসবুকে ওই নারীর ছবি দিয়ে তাঁর সন্ধান চান। ১৩ ফেব্রুয়ারি এক ব্যক্তি ফেসবুকে জাহানারার ছবি দেখে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ধল্লা থেকে জানান, প্রায় একই চেহারার এক নারীর মরদেহ ধল্লার খেয়াঘাটের চানমিয়ার কলাইয়ের ক্ষেতের ভেতরে পড়ে আছে। স্বজনরা দ্রুত সেখানে পৌঁছে ওই মরদেহ জাহানারার বলে শনাক্ত করেন। এরপর খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। আলামত হিসেবে ঘটনাস্থল থেকে একটি গামছা, ওড়না, মোবাইল ফোন সেট ও ভ্যানিটি ব্যাগ জব্দ করা হয়েছিল। ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনের কাছে তাঁর লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, ‘যৌন সংসর্গের’ পর জাহানারাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। তবে চিকিৎসকের প্রতিবেদনে এও বলা হয়, ‘ওই নারী যৌন সংসর্গে অভ্যস্ত ছিলেন’। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৪ ফেব্রুয়ারি সিংগাইর থানায় মামলা হয়। তিন দফা তদন্ত পরিবর্তন করে ছয় মাস পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হত্যার নেপথ্যের যে তথ্য পেল তা চমকপ্রদ। নিখোঁজ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড এবং খুনিকে শনাক্ত করার ঘটনাপ্রবাহও যেন কোনো সিনেমার কাহিনি। জাহানারার সঙ্গে শেষ ফোন কল ও গামছার সূত্র ধরে বেরিয়ে এলো খুনির পরিচয়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রথমে এই মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তারা রহস্য বের করতে ব্যর্থ হওয়ায় মামলাটি সিআইডির কাছে আসে। সেখানে একাধিক দফায় তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়। এরপর হত্যার রহস্য বের করতে নিবিড়ভাবে তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্ত শুরু করে সিআইডি। ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে জাহানারার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তদন্তকারীরা বের করেন– যে দিন নিখোঁজ হয়েছিলেন সেই দিন কার কার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। দিনব্যাপী ৩৫-৪০টি নম্বরে তাঁর কথা হয়। এরপর সেখান থেকে সন্দেহভাজনদের নম্বর কমিয়ে আনা হয়। সন্ধ্যার পর থেকে শেষ দুই ঘণ্টা যারা কথা বলেছিলেন এমন কয়েকটি ফোনকলের সূত্র ধরে শুরু হয় নতুন করে তদন্ত। সেখানে দেখা যায়– ফোন সেট বন্ধ হওয়ার আগে শেষ দুই ঘণ্টায় যাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪টি নম্বর ছাড়া অন্যরা জাহানারার আত্মীয়স্বজন।
প্রাথমিকভাবে ৪টি নম্বর ধরেই তদন্ত এগোতে থাকে। এক পর্যায়ে শেষ ফোনকলের নম্বরটি ঘিরে নতুন ক্লু আসে সিআইডির কাছে। তাতে দেখা যায়, ওই নম্বর ব্যবহারকারী মানিকগঞ্জ ছেড়ে গাজীপুরে অবস্থান করছেন। হত্যাকাণ্ডের পর কয়েক মাস মানিকগঞ্জে অবস্থান করে পরবর্তী সময়ে কেন অন্য জেলায় ওই ব্যক্তি চলে গেলেন– এর কারণ বের করার চেষ্টা চলতে থাকে। তখন বেরিয়ে আসে জাহানারাকে সর্বশেষ যিনি কল করেছেন মূল সন্দেহভাজন সেই তরুণের নাম মো. সোহাগ (২০)। তাঁর গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার গৌরপাড়ায়। দীর্ঘদিন মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। লোমহর্ষক জাহানারা হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর সিরাজগঞ্জের এক তরুণীকে বিয়ে করে মানিকগঞ্জ ছেড়ে গাজীপুরে বসবাস শুরু করেন সোহাগ। সেখানে তিনি একটি পোশাক কারখানার নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে চাকরি নেন। তাঁর স্ত্রীও একই এলাকায় পোশাকশ্রমিক হিসেবে কর্মরত। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে পারিবারিকভাবে তারা বিয়ে করেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত তদন্তের সূত্র ধরে সম্প্রতি সোহাগকে গ্রেপ্তারসহ জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। এরপর হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতেও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। সোহাগ জানান, সিংগাইরে ইটভাটায় কাজের সূত্র ধরেই অনেক দিন ধরে জাহানারাকে চিনতেন। ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের এক দিন আগে মেলা থেকে রাতে ফেরার সময় জাহানারার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই দিন তাঁর মোবাইল নম্বর নেন সোহাগ। পরে বাসায় গিয়ে জাহানারাকে ‘ঘনিষ্ঠভাবে’ সময় কাটানোর প্রস্তাব দেন। বয়সে অনেক ছোট হওয়ায় প্রথমে জাহানারা তাঁর প্রস্তাবে রাজি হননি। এমনকি তাঁকে ‘অপমানজনক’ কথাবার্তাও শোনান। এরপর নাছোড়বান্দা ওই তরুণ পরদিন সন্ধ্যায় আবার ফোন করে একই প্রস্তাব দেন। এক পর্যায়ে রাজি হন ওই নারী। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার রাতে ধল্লা ইউনিয়নের খেয়াঘাটের পশ্চিম পাশে চান মিয়ার কলাই ক্ষেতের ভেতরে যান তারা। এর আগে জাহানারার হাতে ২০০ টাকা দেন সোহাগ। শারীরিক সম্পর্কের পর সোহাগ তাঁর গামছা জাহানারার গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। হত্যার পর জাহানারার ব্যাগ হাতিয়ে সেই ২০০ টাকা পান সোহাগ। তাঁর ধারণা ছিল, পেশাদার যৌনকর্মী হিসেবে জাহানারার ব্যাগে অনেক টাকা থাকতে পারে। ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর পর ভ্যানিটি ব্যাগের অর্থ হাতিয়ে নিতে তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই তরুণ। পরে ঘটনাস্থলে লাশ ফেলে পালিয়ে সিংগাইরে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাহবুবুল আলম জানান, বছর দশেক ধরে জাহানারার সঙ্গে তাঁর স্বামীর কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে ঢাকার বাইরে নতুন সংসার পেতেছেন। এরপর তিনি ভাসমান যৌনকর্মীর পেশা বেছে নেন। পরিবার জানত– মানিকগঞ্জে একটি হারবাল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন জাহানারা। দিনে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ গিয়ে আবার রাতে ফিরে আসতেন। ঘটনার রাতে ঠান্ডা মাথায় তাঁকে খুন করেছে সোহাগ। ঘটনার পর মোবাইল সিমকার্ড নষ্ট করে দেয়। তবে স্ত্রীকে তাঁর ব্যবহৃত ফোন সেটটি দিয়েছিলেন ওই তরুণ। প্রযুক্তিগত তদন্ত, আসামির স্বীকারোক্তির পর এখন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার গামছার ডিএনএ করানো হবে।
Advertisement