গ্রাম্য পশুচিকিৎসক দালাল নাসিরের সম্পদের পাহাড় (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মাদারীপুর প্রতিনিধি ,মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট ২০২৩ : পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের অধিগ্রহণ করা জমির দলিল জালিয়াতি করে এবং ভিন্ন নারী-পুরুষকে জমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে অর্থ উত্তোলন করে গ্রাম্য পশুচিকিৎসক নাসির কাজি কোটিপতি বনে গেছেন। মাদারীপুরে রেললাইন স্থাপন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অধিগ্রহণ খাতের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে নাসির কয়েক বছরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। চার-পাঁচ বছর আগে অর্থের অভাবে যে নাসির শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে পর্যন্ত যেতেন না, বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে শতকোটি টাকার মালিক। তার একসময়ের সহযোগী, সাবেক স্ত্রীর স্বজনরা দালাল নাসিরের ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করেছে। তাদের মধ্যে জেল খাটা সহযোগীরাও রয়েছেন। দালাল নাসিরের এলাহি কাণ্ডকারখানার গল্প মানুষের মুখে মুখে। বর্তমানে নাসির কাজি পলাতক। সরেজমিন অনুসন্ধানে তার অপকর্মের তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে দালাল নাসির কাজিসহ ২০ দালালের তালিকা করেছে জেলা প্রশাসন (ডিসি অফিস)। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুয়া নথি ও ভুয়া মালিক সাজিয়ে অধিগ্রহণ করা জমির শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার। এ অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতির দায়ে ইতোমধ্যে ডিসি অফিসের দুই কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। তহশিলদার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কিন্তু নাসির কাজিসহ দালালচক্রের সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাসির কাজিকে গ্রেফতার ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সূত্র জানায়, শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের বাঁচামারা গ্রামের মোজাজ্জেল হকের ছেলে কেএম নাসির (নাসির কাজি) ভুয়া বিল ছাড়াও অন্যের বিলও তুলে নিয়েছে। তাকে সহযোগিতা করেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শিবচরের মাদবরচরের ডাইয়ারয়ার চর মৌজায় রেললাইন প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হারুন বেপারি, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেন ডিসি অফিস থেকে নোটিশ পান। অনেকদিন পর তারা জানতে পারেন-ওই জমিগুলোর ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নাসিরের নেতৃত্বে দালালচক্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তুলে নিয়েছেন। এ অর্থ উঠানোর অভিযোগে শাহীন বেপারি নামে এক দালালকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা প্রতারণা মামলায় নাসির কাজি, তার দুই মামা ও এক নিকটাত্মীয়কে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের কেউই ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট করেছে। শাহীনের পরিবার (দালাল নাসিরের সহযোগী) জানায়, তারা ২০ লাখ টাকা ভাগ পেয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হারুন বেপারি বলেন, আমাদের সব কাগজপত্র আছে। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্র অফিসে দাখিল করে নাসির কাজি ও শাহীন বেপারিসহ চারজন ১ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর সঙ্গে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত। হারুন বেপারি বলেন, দালাল নাসির ও তার দুই মামাকে আইনের আওতায় আনা হলে তাদের টাকা আদায় করা সম্ভব।

শাহীন বেপারির ছেলে দাদন বেপারি বলেন, নাসির কাজি ও তার দুই মামা আলিউজ্জামান ও আখতারুজ্জামানসহ ডিসি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আমার আব্বাকে জিম্মি করে ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করিয়েছে। ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে আব্বাকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিল। এ ঘটনায় পুলিশ আমার আব্বাকে ডিসি অফিসে যেতে বলে। সেখানে গিয়ে সব কথা স্বীকার করলে আব্বাকে জেলে পাঠানো হয়। আব্বা বলেছেন, নাসির কাজি তার সামনে কয়েকদিনে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া আরও কত টাকা নিয়েছেন, এর কোনো হিসাব নেই।

গ্রেফতার ইউপি সদস্য সুধাংশ মন্ডল বলেন, নাসির কাজি একসময় পল্লি পশুচিকিৎসক ছিলেন। পশু চিকিৎসা করে দিনে দেড়শ-দুইশ টাকা কামিয়ে তিনি কোনোমতে সংসার চালাতেন। রেললাইনের ভূমি অধিগ্রহণের সময় ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তিনি এখন শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার দুর্নীতির সঙ্গে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত। তারাই তো ফাঁকফোকর ধরিয়ে দিয়েছে। আমার মতো অনেকের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নাসির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ আমরা ফেঁসে গেছি। তিনি বলেন, নাসিরকে ধরতে পারলে এ দুর্নীতির সঙ্গে আর কারা জড়িত, তা বের হয়ে আসবে। আমরাও রেহাই পাব।

Advertisement

নাসিরের সহযোগী মুকুলী রানী বলেন, ‘প্রথমবার ও আমাকে দিয়ে ৬৩ লাখ টাকা উঠিয়ে আমাকে তিন লাখ টাকা দেয়। এরপর কয়েক লাখ টাকা উঠিয়ে এক লাখ টাকা দেয়। এভাবে নাসির ও ডিসি অফিসের লোক মিলে শত শত মানুষের বিল উঠিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষগুলোরে বিপদে ফেলেছে। ওকে ধরলে সব বের হয়ে আসবে।’ নাসির কাজির সাবেক স্ত্রীর বড় বোন বলেন, আমার বাবার বাড়ি আসতে ১০ টাকা ভাড়া লাগত। তা দিয়েও সে আসতে পারেনি। এখন কয়েকদিন পরপর সে পরিবার নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। বিবাহবার্ষিকীতে ১৪-১৫ লাখ টাকা খরচ করে। বাচ্চা হওয়ার পর সোনার চামচ ও বাটি দেয়। এলাহি কাণ্ড আর কী? বলে শেষ করা যাবে না।’

নাসির কাজির বাড়িতে গিয়ে তার মোবাইল ফোন নম্বর চাইলেও কেউ দিতে পারেনি। তার ভাই মতিউর কাজি মোবাইল ফোনে জানান, ‘তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। আমার জানামতে সে ঢাকা বা ভারত আছে।’

নাসিরের মামা ও প্রতারণার মামলার আসামি আলিউজ্জামান বলেন, আমাদের সঙ্গে শত্রুতাবশত মামলাটি দেওয়া হয়েছে। আপনার ভাগিনা (নাসির) এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন-এর কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র চন্দ বলেন, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় দুই স্টাফকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা ও তহশিলদারের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। দালালদের তালিকা দুদকে দেওয়া হয়েছে।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের মূল উৎপাটন করা হবে। আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও তাদের বয়কট করা হবে।

নাসিরের আলাদিনের চেরাগ : নাসির কাজি ছিলেন একসময়ের গ্রাম্য পশুচিকিৎসক। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। পাশের উপজেলায় শ্বশুরবাড়িতেও বেড়াতে যেত না টাকার অভাবে। তার সহযোগী ও সাবেক স্ত্রীর স্বজনদের দাবি-বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে নাসিরের আলিশান ভবন, ঢাকার গুলশানে ফ্ল্যাট, উত্তরায় ফ্ল্যাটসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে।

Advertisement

এছাড়া কক্সবাজারে তিনি বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করছেন। তার একাধিক গাড়ি রয়েছে। তার ও দ্বিতীয় স্ত্রীর মোবাইল ফোনের ব্যাক কভার স্বর্ণের। দ্বিতীয় ঘরে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর স্বর্ণের বাটি ও চামচ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর বিবাহবার্ষিকীতে ১০০ ভরি স্বর্ণালংকার উপহার দেওয়ারও গুঞ্জন রয়েছে। তার বাসার দেওয়াল ঘড়ির দাম দেড় লাখ টাকা। বাসার ফার্নিচার দুবাই থেকে আমদানি করা। সব মিলিয়ে নাসির কাজির এলাহি কাণ্ডকারখানা।