রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের পরিবার দণ্ড স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন।মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয় তখন এসে এমন আবেদনকে আদালত অবমামনার শামিল এবং রাষ্ট্রপতির আদেশের প্রতি অশ্রদ্ধা বলছেন ড. তাহেরের কন্যা এবং এ মামলার আইনজীবী।
Advertisement
যদিও এমন আবেদনে দণ্ড কার্যকরে কোন বাধা দেখছেন না তিনি। দ্রুত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবিও জানিয়েছেন সহকর্মীরা। তারা বলছেন এমন রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শিক্ষক হয়ে শিক্ষককে হত্যার যে ন্যাক্কার জনক ঘটনার বিচার তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারের বাসা থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক তাহের। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। ২ ফেব্রুয়ারি বাসার পেছনে ম্যানহোল থেকে উদ্ধার হয় এ অধ্যাপকের মরদেহ।
দীর্ঘ দিনের বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত ৫ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ হয় মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক শিক্ষক মহিউদ্দীন এবং কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরের। এরপর সবাই অপেক্ষ করছিলো রায় কার্যকরের। কিন্তু হঠাৎ গত ১০ জুলাই দণ্ডপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীরকে ২০০৬ সালে তিনদিন থানায় আটক রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করে তার পরিবার। একইসঙ্গে রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশও চাওয়া হয়। জাহাঙ্গীরের ভাই সোহরাব হোসেন আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামীর মাধ্যমে এই রিট আবেদন জমা দেন। যা ১০ জুলাই সোমবারেই পাঠানো হয়েছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। এরপর থেকে জাহাঙ্গীরের ভাই সোহরাব হোসেন ঢাকা আদালত পাড়াতেই রয়েছেন।
বুধবার (১২ জুলাই) দুপুরে রাজশাহী মহানগরীর বিনোদপুর এলকার খোঁজাপুর মধ্যপাড়া মহল্লায় গিয়ে জাহাঙ্গীরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এ প্রতিবেদক। সোয়া দুই কাঠা জমির ওপর টিনের আধাপাকা এবটি বাড়ি। অধিকাংশই ভগ্ন রুগ্ন অবস্থা। পরিবারের বেশি সদস্য চোখে না পড়লেও বারান্দায় অসুস্থ্য অবস্থায় শয্যাশায়ী রয়েছেন জাহাঙ্গীরের বাবা মুনশি। যার পরিচয় ১০ জুলাই সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামীর করা রিটে জাহাঙ্গীরের বাবা হিসেবে দেয়া হয়েছে। সেখানে তাকে মৃত হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাওয়া গেলো জীবিত অবস্থায়। তার মেজো ভাই নজরুল ইসলাম তখন বাড়িতে ছিলেন। তার দাবি, রাজনৈতীক ভাবে তার দুই ভাইকে ফাঁসানো হয়েছে। দুই ভাই বলতে এখানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাহাঙ্গীর এবং আরেক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালামের নাম বলা হয়েছে। যদিও এতোদিন গণমাধ্যমে নাজমুলকে তার ভাই এবং সালামকে নাজমুলের শ্যালক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
Advertisement
নজরুল বলেন, তখন জাহাঙ্গীরের বয়স ১৬ কি ১৭ হবে। ড. তাহের স্যারের বাসায় বেশ কিছুদিন কেয়ারটেকারের কাজ করছিলো। সেই সময় পরিচিতদের মাধ্যমে সপ্তাহ খানেক ধরে পার্শ্ববর্তী আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়াটারে বড় ভাই সালামকে একই কাজ পাইয়ে দেন। ঘটনার পর ৩ ফেব্রুয়ারি মামলা হলে পুলিশ নিজ বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর এবং কর্মস্থল থেকে সালামকে আটক করে নিয়ে যায়। এখন যেহেতু জাহাঙ্গীরের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে গেছে তাই তারা যেকোন মূল্যে মৃত্যুর মুখ থেকে ভাইকে ফেরাতে শেষ বারের মতো আদালতের শরনাপন্ন হয়েছেন। আবেদনের বিষয়ে কথা বলতে তাদের আরেক ভাই মিজানুর কারাগার কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করেছেন।
এদিকে বিশ্বস্ত একটি কারা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, ১০ জুলাই সোমবার জাহাঙ্গীরের পরিবারের করা রিটের কপি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছলে তারা একটি আলোচনায় বসেন। সেখানে অন্তত ৭ দিন ফাঁসি কার্যকর করতে সময় নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সে হিসেবে এই দুজনের মৃত্যুদণ্ড ১৮ জুলাইয়ের পর যে কোন সময় কার্যকর হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কারা কর্তৃপক্ষ মনে করে এই সময়ের মধ্যে আদালতে করা জাহাঙ্গীরের রিটটির সুরাহা হয়ে যাবে।
তবে এ বিষয়ে টেলিফোনে ড. তাহের আহমেদের কন্যা এবং এ মামলার আইনজীবী সাগুফতা আহমেদ বলছেন, মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে যা যা সুযোগ পেতে পারে তা সবই সম্পন্ন হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের মাধ্যমে। সেটি নাকচ হয়ে যাওয়ায় এরপর আর কোন আইনি প্রক্রিয়া চলতে পারে না। এই আবেদনের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী নিঃসন্দেহে আদালত অবমাননা এবং রাষ্ট্রপতির প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। রিটকারী আইনজীবীর বিরুদ্ধে শিঘ্রই তিনি আদালতে লড়বেন বলেও জানান সাগুফতা আহমেদ। এ ঘটনায় তিনি খুব বেশি কিছু বলতে চাননি। শুধু পরিবারের পক্ষ থেকে চেয়েছেন অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হোক।
Advertisement
এদিকে ড. তাহের আহমেদের সহকর্মী ড. সুলতান উল ইসলাম এবং ড. চৌধুরী সারওয়ার সজল ফাঁসির দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে বলেন, রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শিক্ষক হয়ে শিক্ষককে হত্যার সুষ্ঠু বিচার প্রাপ্তি অন্যদের জন্য দৃষ্ঠান্ত হয়ে থাকবে। আর আইবিএ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাছানাত আলী মনে করেন এখনও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে নানা ভাবে হয়রানি করা ও হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। তাদের জন্য এই মামলার রায় কার্যকর একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। যে অন্যায় করলে তার ফল ভোগ করতেই হবে।