যেভাবে প্রিগোজিনকে হাতের মুঠোয় নিলেন পুতিন (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ,রোববার, ২৫ জুন ২০২৩ : ক্রেমলিনের দুই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘোষণা দিয়ে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপ এখন উল্টোপথে দৌড়াচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে নিজেদের ঘাঁটিতে। তাদের নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনও আছেন দৌড়ের উপর।

Advertisement

মস্কো দখলের উদ্দেশ্য লিপেৎস্ক থেকে প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার এগিয়েও আচমকাই থমকে যায় প্রিগোজিনের ভাড়াটে সেনাবাহিনী। টেলিগ্রামে দেয়া বার্তায় প্রিগোজিন জানান, রুশ বাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য রক্তপাত এড়াতেই আপাতত মস্কো অভিযান স্থগিত। যোদ্ধার ফিরে যেতে বলা হয়েছে।

ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে ক্রেমলিনের কঠোর অবস্থান ও রুশ নেতা পুতিনের হুশিয়ারী বিবেচনায় নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হন বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। পুতিনের সাথে সমন্বয় করে, প্রিগোজিনের সাথে একটি সমঝোতা আলোচনায় বসেস তিনি।

এরপরই প্রিগোজিন ঘোষণা দেন, ওয়াগনার তার কনভয়গুলোর চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে, যেগুলো মস্কোর দিকে রওনা হয়েছিলো তারা ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। মস্কো জানায়, ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে সব অভিযোগও তুলে নেয়া হয়েছে। তাদের অপকর্মের কোন বিচারও হবে না।

চলতি সপ্তাহেই, ইউক্রেনের সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে অভিযান শুরু করে ওয়াগনার। বাহিনী। প্রিগোজিনের ভাড়াটে যোদ্ধারা শনিবার সকালে ইউক্রেন সীমান্তের অদূরে পশ্চিম রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর ভোরোনেজ দখল নিয়েই মস্কো অভিমূখে যাত্রা করে।

এর আগে ওয়াগনার বাহিনী শুক্রবার ইউক্রেন সীমান্ত লাগোয়া রোস্তভ-অন-ডন শহরের দখল নেয়। প্রিগোজিন দাবি করেন, একটি গুলি খরচ না-করেও শহরটির সেনার সদর দফতর দখল করে তাঁর বাহিনী। আর এতে সহায়তা করেছেন স্থানীয়েরা।

Advertisement

প্রিগোজিনের ভাষায়, তাঁর বাহিনী ‘ন্যায়ের পদযাত্রা’য় নেমেছে। রোস্তভ-অন-ডন থেকে মস্কোর দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার। এর পর মস্কোর দিকে আরও ২০০ কিলোমিটার এগিয়ে যায় তারা। কিন্তু তার পরেই আচমকা বন্ধ অভিযান। হঠাৎ করেই বদলে যায় দৃশ্যপট।

পশ্চিমা মিডিয়ার বিশ্লেষন, মস্কো অভিযান অসমাপ্ত রাখার চাপের উৎস রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনই। লুকাশেঙ্কোকে কাজে লাগিয়ে তিনি ভাড়াটে বাহিনীর মধ্যে ভয় ধরাতে সফল হন। পাশাপাশি, প্রিগোজিন মস্কো দখলে জনসাধারণের কাছে যে আহবান রেখেছিলেন তা কাজে আসেনি।

বিনা রক্তপাতে রোস্তভ-অন ডন দখল করতে পারায় প্রিগোজিন মনে করেছিলেন, মস্কো দখলও সহজ হবে। কিন্তু বেলারুশ নেতা লুকাশেঙ্কো প্রিগোজিনকে বুঝাতে সক্ষম হোন, মস্কোতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পরবে ওয়াগনার বাহিনী। ভয়াবহ রক্তপাতের মুখোমুখি হবে তারা।

লুকাশেস্কো আরও বুঝাতে সক্ষম হন যে, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ তো দূরের কথা সাধারণ মানুষও ওয়াগনার বাহিনীর প্রতি কোন আগ্রহ দেখায়নি। তাই সম্ভবত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকেই মস্কো অভিযান বাতিল করেন প্রিগেজিন।

মস্কো অভিযান বাতিলের পর প্রশ্ন ওঠছে, কী হবে প্রিগোজিনের? তার রাজনৈতিক বা সামরিক ভবিষ্যৎ এখন পুতিনের হাতের মুঠোয়। আপাতত নিরাপদ জায়গা হিসাবে রাশিয়া ছেড়ে গিয়ে বেলারুশ থাকবেন প্রিগোজিন। তবে সেটিও পুতিনের আওতার মধ্যেই।

ক্রেমলিন সূত্র বলছে, দুই পক্ষের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তার আওতায় প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ও মামলা তুলে নেয়া হবে। তাঁর ডাকে সশস্ত্র বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান ঘটাতে শামিল সব ভাড়াটে সেনাদের বিরুদ্ধেও কোন ধরনের আইনি পদক্ষেপ করা হবে না।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ওয়াগনারের বাকি সদস্য, যাঁরা এই বিদ্রোহে অংশ নেননি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে তাঁদের। পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে লুকাশেঙ্কোর। তাঁর হস্তক্ষেপেই এবারের মতো সঙ্কট এড়ানো গেলো।

শনিবার পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, মস্কোর আশেপাশের এলাকায় ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচলও। তবে দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছনোর পর রাস্তাঘাট আবারও খুলে দেয়া হয়। যান চলাচল এই মুহূর্তে স্বাভাবিক বলে জানা গিয়েছে।

প্রিগোজিন যখন মস্কোর দিকে এগোচ্ছে যেতে শুরু করেন, তখনও এনিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি পুতিন। তাঁর মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ জানান, আর পাঁচটা দিনের মতো ক্রেমলিনে নিজের দফতরে কাজ সেরেছেন পুতিন। ফাঁকে প্রিগোজিনকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন পুতিন।

ইউক্রেন যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে মতবিরোধ চলছিলো প্রিগোজিনের। সেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করে সম্প্রতি। প্রিগোজিন সিদ্ধান্ত নেন তাদের চ্যালেঞ্জ করার।

সাম্প্রতিক সময়ে তিনি রুশ নেতৃত্বের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই তিনি নিজেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি যোগ্য বলে দাবি করছেন। আর সাম্প্রতি হঠাৎ করেই বাখমুত পতনের পর রাশিয়া বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ আনেন প্রিগোজিন।

তাঁর দাবি, একটি ক্যাম্পে মিসাইল হামলা চালিয়ে তার অনেক যোদ্ধাকে হত্যা করেছে রাশিয়া। এ হামলার প্রতিশোধ রাশিয়ার সেনাদের শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন প্রিগোজিন। তিনি বলেছন, এটি তাঁদের ‘ন্যায় বিচার’ পাওয়ার একটি চেষ্টামাত্র, কোনো ‘সামরিক অভ্যুত্থান’ নয়।

এর আগে গত মার্চে এক পুতিনের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকার’ অভিযোগ তোলেন প্রিগোজিন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমাদের সেনারা (ওয়াগনার সেনারা) ইউক্রেনের বখমুত শহর দখলের চেষ্টা করছে। কিন্তু মস্কো আমাদের পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ করছে না।

তারপর থেকেই মূলত পুতিন ও প্রিগোজিনের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্য হতে শুরু করে। যদিও প্রিগোজিন বারবার বলে আসছেন, পুতিনের সঙ্গে তার কোন বিরোধ নেই। এক সময় পুতিনের খুব ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ছিলেন প্রিগোজিন।

গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিলো প্রিগোজিনের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পুতিনের বাহিনী অভিযান শুরুর পর সেখানে রুশ বাহিনীর সহযোগী হিসেবে প্রিগোজিনের ভাড়াটে সেনাদের লড়াই করতে দেখা গেছে।

Advertisement

ধারণা করা হয়, ওয়াগনারের সেনাদের কারণেই ইউক্রেনে রুশ বাহিনী ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। এমনকি সবশেষ বাখমুত দখলে নিতে রুশ সেনাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর, এই ওয়াগনার সেনারা অল্প দিনের মধ্যে শহরটির পতন ঘটাতে সক্ষম হোন।