সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ড অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা, জড়িত সবাই প্রভাবশালী(ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),জামালপুর প্রতিনিধি,শনিবার, ১৭ জুন ২০২৩ :জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে অনেক আগেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল আলম বাবু। তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। হত্যায় জড়িতরা এলাকায় প্রভাবশালী। তাঁদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। নিহতের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা এসব তথ্য দিয়েছেন।

Advertisement

এদিকে গতকাল শুক্রবার শোক আর শ্রদ্ধায় নাদিমকে চিরবিদায় জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। নিজ এলাকায় দুই দফা জানাজা শেষে দাদা-দাদির কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নাদিমকে নির্মম হত্যাকাণ্ডে সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ছাড়াও শোকের ছায়া নেমে এসেছে জামালপুর জেলার মানুষের মধ্যে।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারাদেশের সাংবাদিকরা গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। এসব কর্মসূচিতে তাঁরা বলেন, সাংবাদিকরা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হলে তার কোনো বিচার হয় না। সাংবাদিক সাগর-রুনি, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, শামছুর রহমান, আব্দুল হাকিম শিমুলসহ সারাদেশে অসংখ্য সাংবাদিক হত্যার শিকার হলেও তার বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাংবাদিক হত্যার তালিকাকে দীর্ঘ করছে।

Advertisement

বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুর নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্ম নিয়ে একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন বাংলানিউজ ও একাত্তর টিভির সাংবাদিক নাদিম। সংবাদ প্রকাশের জেরে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে নাদিমের বিরুদ্ধে মামলাও করেন বাবু। আদালত ওই মামলাটি খারিজ করে দেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বুধবার রাতে বাবুর বাহিনী নৃশংস হামলা চালায় তাঁর ওপর। চেয়ারম্যান বাবু ও তাঁর ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত হামলার নেতৃত্ব দেন। বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তিন সন্তানের জনক চল্লিশোর্ধ্ব নাদিমের।

জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। নিহত সাংবাদিকের ওপর হামলাকারীদের সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশের পাঁচটি দল মাঠে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।

এ হত্যাকাণ্ডে গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। মূল হোতা বাবু এখনও গ্রেপ্তার হননি। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে। গতকাল বিকেলে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরে তিনি নাদিমের বাড়িতে যান। তিনি নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা বাবুসহ সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হবে।

নাদিমের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে জামালপুর জেলায় কর্মরত সাংবাদিক ছাড়াও বকশীগঞ্জের সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংস্থা থেকে ঘোষণা করা হয় আন্দোলন কর্মসূচি। নাদিমের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবিতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন বকশীগঞ্জে কর্মরত সাংবাদিকরা। এ ছাড়া জামালপুর প্রেস ক্লাব ও বকশীগঞ্জ প্রেস ক্লাব তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণাসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে।

নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান বাবু তাঁর স্বামীর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। আগেও তিনি নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলে রিফাতসহ ১০-১২ জন মিলে হামলা করে তাঁকে হত্যা করেছে। হামলার সময় বাবু চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসির দাবি জানান।

তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যান বাবুর অপকর্ম নিয়ে লেখালেখির পর নাদিমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। সেই মামলাটি বুধবার ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেন। এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন নাদিম। এর পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে নাদিমের ওপর হামলা হয়।

হামলায় জড়িত বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক আল মোজাহিদ বাবু বলেন, নাদিমকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর তাঁকে মারতে মারতে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন বাবুর ছেলে রিফাত ও তাঁর গুন্ডা বাহিনী। ঘটনার সময় ওই গলিতে অন্ধকারে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবু।

বকশীগঞ্জ প্রেস ক্লাব সভাপতি শাহীন আল আমীন বলেন, গত ১০ মে সন্তানের পিতৃত্বের দাবিতে চেয়ারম্যান বাবুর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। ২০ মে  সাবিনা ইয়াসমিন তাঁর স্বামী বাবুকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার চেয়ে আবেদন করেন উপজেলা শাখার নেতাদের কাছে। এ নিয়ে বাংলানিউজে সংবাদ প্রকাশ করেন নাদিম।

শাহীন বলেন, নাদিমের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। যতদিন বাবুসহ সব আসামি গ্রেপ্তার না হবেন, ততদিন ঘরে ফিরবেন না সাংবাদিকরা।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ সমকালকে বলেন, এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারম্যান বাবুর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাদেশে বিক্ষোভ

সাংবাদিক নাদিমকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদ ও হামলায় জডি়তদের শাস্তি দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন সাংবাদিকরা। কর্মসূচিতে বক্তারা সারাদেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্তসাপেক্ষে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানান।

গতকাল সকালে দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার সামনে মানববন্ধন এবং ফরিদপুর প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। খাগড়াছড়িতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা মৌন পদযাত্রার মাধ্যমে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।

নাটোর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এবং রাজবাড়ীর পাংশায় মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নড়াইল প্রেস ক্লাবের সামনে এবং মাদারীপুরের শিবচরেও প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছেন সাংবাদিকরা।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় টিআইবি 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যা দেশে স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। আর এসব নির্যাতন ও নিষ্ঠুর হত্যার সর্বশেষ শিকার সাংবাদিক নাদিম। গতকাল সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দেশে সাংবাদিক নির্যাতনে বিচারহীনতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এসব ঘটনা ঘটছে। এখন সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের সদিচ্ছার উদাহরণ সৃষ্টিতে এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জেরে নাদিম হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেই সাংবাদিকের ওপর হামলা, নির্যাতন, আটক, গুম এমনকি হত্যা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে।

Advertisement

তিনি বলেন, নাদিম হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে– জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধররা নিজেদের দুর্নীতি-অন্যায় লুকিয়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।