ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজশাহী প্রতিনিধি,সোমবার, ২২ মে ২০২৩ : দেখে মনে হতেই পারে সাজানো গোছানো সুন্দর পরিপাটি কোনো রান্নাঘর। যার চারপাশে রয়েছে ৮টি ছোট ছোট ঘর, কোনোটির দরজা খোলা, ভেতরে রান্নায় ব্যবহৃত তৈজসপত্র থরে থরে সাজানো। কোনো ঘরের টিনের দরজা লাগানো, সামনে থরে থরে খড়ি সাজানো। ওপরে টিনের ছাউনি, নিচে পাকা করা বারান্দা।
Advertisement
এটি সিটি করপোরেশনের একটি গণশৌচাগারের চিত্র। যেখানে এক সারিতে ৬টি স্নানাগার ও ২টি টয়লেট রয়েছে। ছিল পানির সুব্যবস্থাও। কিন্তু ৭ বছর আগে প্রভাবশালীদের দখলে এটির বর্তমান অবস্থা এমন। যেন পুকুর চুরি নয় শৌচাগার চুরির ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী সিটির ঘনবসতিপূর্ণ ২টি ওয়ার্ডের একটি অংশে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য শৌচাগার দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেউ শোবার ঘরের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়ে ব্যবহার করছেন এই টয়লেট। কেউবা পুরোটা দখল করে বানিয়েছেন বিশাল রান্নাঘর। এলাকাটিতে পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। তবে দখলের বিষয়ে অবস্থানকারীরা বলছেন স্থানীয় কাউন্সিলরদের অনুমতি নিয়েই তারা এটি দখল করেছেন।
Advertisement
এই যেমন হাদির মোড় নদীর বাঁধের ওপর রাস্তা পেরিয়ে দক্ষিণে নামলেই পিপিলীকা একাডেমির গণিত শিক্ষক মাসুদ রানার বাড়ি। দোতলা বাড়ির পুরোটাই দালানের। বাড়ির পূর্ব দিকে সীমানা লাগোয়া একটি সরকারি গণশৌচাগার ছিল। সেটিকে মাসুদের পরিবার সীমানার মধ্যে টিন দিয়ে ঘিরে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। রোববার দুপুরে সরেজমিনে টয়লেটটি খুঁজতে গেলে এ প্রতিবেদককে বেশ বেগ পোহাতে হয়। কারণ বাড়িটির সদর দরজা কলাপসিবল গেট তালা বন্ধ করা। অর্ধেক গেট থেকেই টিনদিয়ে ঘিরে নেয়া হয়েছে শৌচাগারটি। পশ্চিমের খানিকটা পাড়া ঘুরে বাড়িটির অন্য দরজা দিয়ে যখন ভেতরে প্রবেশ করা হলো তখন লম্বা একটা বারান্দা পেরিয়ে আঙিনায় নামলেই সামনে থেকে স্পষ্ট হলো শৌচাগারটি। পুরো সীমানা টিন দিয়ে উঁচু করে ঘেরা।
শৌচাগারের বারান্দায় তখন রান্নায় ব্যস্ত একজন স্ত্রীলোক। পরিচয় দিলেন সেই বাড়ির বউ। তার দাবি, বছর সাতেক পূর্বে এই স্থানটিতে মাদকসেবীরা আখড়া বানিয়ে ফেলেছিল। তারা সেটি বন্ধ করতে ২৪নং কাউন্সিলর আরমান আলীর অনুমতি সাপেক্ষে পুরোটা নিজেদের মতো ঘিরে ব্যবহার শুরু করেছেন।
এটিতে অন্যদের আসার সুযোগ রয়েছে কি না? এমন প্রশ্নে বাড়ির বাসিন্দারা জানান, তারা মাদক নির্মূলেই এমনটা করেছেন। কাউন্সিলর ছেড়ে দিতে বললে ছেড়ে দেবেন। কলাপসিবল গেটটি দিয়ে ড্রেনের ওপর স্লাব দেয়া রাস্তা। সেই রাস্তা ৪ ফিটের বেশি চওড়া নয়। সেখানে দুপাশে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করে থাকছেন বেশ কিছু পরিবার। রাস্তাটির ওপর তাদের রান্না করতে দেখা গেল।
না প্রকাশ না করে একজন জানালেন, গণশৌচাগারটি সেই পরিবার দখলে নেয়ায় তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের গোসলের সমস্যায় পড়তে হয়। রাস্তাটি যেখানে বাঁধের সিঁড়িতে মিলেছে সেখানে ডানপাশে একটি মাত্র পানির কল, তাও ভাঙা। সেখানে খোলা আকাশের নিচে কাপড় আর বস্তা টাঙিয়ে উচু রাস্তা থেকে স্থানটি গোসল করার জন্য নারীরা আলাদা করেছেন। এ নারীরা বলছেন, জনগণের সম্পত্তি দখল করে রান্নাঘর বানিয়ে পরিবারটি জোর করে দখলে নিয়েছে। কারও কিছু করবার নেই। তারা তাদের গোসলের স্থান ফেরত চান।
রাজশাহী নগরীর সবচেয়ে জনবহুল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত শহর রক্ষা বাঁধের দক্ষিণে ২৩ ও ২৪নং ওয়ার্ডের একাংশ বাজে কাজলা, পঞ্চবটি, হাদির মোড়ের একাংশ নিয়ে এলাকাটিতে অন্তত ৪০০ পরিবারের বাস। এ এলাকায় রয়েছে নগরীর সবচেয়ে বড় শ্মশান। হিন্দু ধর্মীয় নানা আয়োজনও হয় সেখানে। প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১টি। মসজিদ রয়েছে কয়েকটি। আরবান স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি। ২ যুগেরও বেশি সময় পূর্বে এলাকাটির মোট ৪টি স্থানে একসাথে ৬টি করে গোসলখানা ও ২টি টয়লেট তৈরি করে দিয়েছিল রাজশাহী সিটি করপোরেশন।
বর্তমানে যেগুলোর অধিকাংশই জরাজীর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। কোথাও টিনের দরজা ভাঙা, অবকাঠামো ভেঙে পড়ার মতো। কোথাও ছাগলের ঘরে রুপান্তরিত হয়েছে শৌচাগারগুলো। পঞ্চবটি এলাকার আরবান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেই হাতের ডানে একটি গণশৌচাগার রয়েছে। সেখানে একটি মাত্র টয়লেট বাঁকি রেখে সবগুলো বাড়ির সীমানার সঙ্গে লাগিয়ে নিজেদের মতো করে ঘিরে ভোগ করছে একটি পরিবার।
খোঁজ খবর নিতে গেলে তারা জানান, পাশেই তাদের বাড়ি ছিল, অস্থায়ীভাবে থাকতেই এখানে এসেছেন তারা। যদিও অনেকেই বলছেন দীর্ঘ দিন ধরে এ স্থানটিতে অনেকেই থাকেন। যে টয়লেটটি ব্যবহার উপযোগী তার সামনেই একটি হাউজ রয়েছে, দুপুর হলেই সেখানে গোসল করতে আসা মানুষের ভিড় চোখে পড়বে। সেখানে ছবি নিতে গেলে স্থানীয় রিপন নামে এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদকের ওপর ক্ষুব্ধ হন। ছবি নিতে ও সংবাদ প্রকাশে বাধা দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ২৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহতাব চৌধুরীকে ফোন করে বিষয়টি অবগত করেন।
এলাকাটিতে এক সময় ঘনবসতি কম ছিল, তখন জনসাধারণকে টয়লেটমুখী করতেই সিটি করপোরেশন এ উদ্যোগ নিয়েছিল। এখনও অনেককে পাওয়া গেল যাদের বাড়িতে টয়লেট নেই। শ্মশানের কিছুটা আগে গলির মধ্যে এমন দুটি গণশৌচাগার মিলেছে, যেখানে খুব জরাজীর্ণ অবস্থাতেও এলাকাবাসী সেগুলো ব্যবহার করছে। শুধু শৌচাগারের সমস্যা নয়, রয়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা ও জলাবদ্ধতা।
Advertisement
যদিও এ শৌচাগারগুলোর বর্তমান হালহকিকত ও দখলের বিষয়ে জানতে ২৩ ও ২৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরা দখলকারীদের বিপক্ষে সাফাই দিলেন। আরমান আলী অনুমতির বিষয়ে অস্বীকার করে বলেছেন, যে পরিবার তার দোহাই দিয়েছে তাদেরকে অনুমতিপত্র দেখাতে বলুন। তাছাড়া এসবের জন্য তো বাজেট নেই, তাই নিয়মিত দেখভাল করা হয় না। তবে বহুবার সংস্কার, দলখ উচ্ছেদের কথা বলেছেন তিনি। আর ২৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহাতাব চৌধুরী বলছেন, নতুন স্কিমের মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ করে নতুন রূপে গণশৌচাগার নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাঁধের ওপর দিয়ে যে নতুন রাস্তা করার পরিকল্পনা রয়েছে সেই রাস্তা নির্মাণের সময় এগুলো ঢেলে সাজানো হবে। যদিও এখন সকলের ঘরে ঘরে টয়লেট ও গোসলখানা রয়েছে। তবুও আমরা জনস্বার্থে এগুলো নির্মাণ করে দেব।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এই এলাকাটিতে ভোটার সংখ্যা অন্তত ৭ হাজার। জনবসতিপূর্ণ ও নদীর ধার ঘেঁষা নিচু এলাকা হওয়ায় এলাকাটিতে নাগরিক সুযোগ সুবিধা কিছুটা অপ্রতুল। এলাকাবাসী চাইছেন অচিরেই দখল হওয়া শৌচাগারগুলো দখলমুক্ত হোক।