ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ১৬ মে ২০২৩ : গো-খাদ্যের চড়া দামে তলানিতে ঠেকেছে গো-খামারিদের লাভ। অনেক খামারি এখন গরু মোটাতাজা করা ছেড়ে দিয়েছেন। গত ১০ বছরে গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে ৬-৭ গুণ, এর মধ্যে গত তিন বছরেই দাম বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। এতে অধিকাংশ খামার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গো-খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, এনজিও ঋণের অতিরিক্ত সুদ, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও বাছুরের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
Advertisement
জানা গেছে, প্রায় দেড় দশক ধরে পাবনায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু মোটা তাজাকরণ শুরু হয়েছে। জেলায় প্রায় ১৮ হাজার খামারি রয়েছেন যারা বাণিজ্যিকভাবে গাভি ও ষাঁড় পালন করেন। আরও অন্তত ২০-২৫ হাজার ক্ষুদ্র কৃষক নিজ উদ্যোগে গরু মোটাতাজাকরণ করেন।
এছাড়া জেলায় প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র নারী এনজিওর টাকায় গরু পালন করেন। ১০ বছর আগেও মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন ষাঁড় পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। তবে এখন খামারভিত্তিক গরু পালনে খরচ বেশি হওয়ায় কেউ কেউ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে খামার গুটিয়ে নিয়েছেন।
বেশ কিছু খামার মালিক ও ক্ষুদ্র চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগেও বাড়িতে দুটি গরু পালন করে বছরে লাখ টাকা মুনাফা হতো। সেক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকায় একটি বাছুর কিনে এক বছর লালন করে বছর শেষে (কোরবানি মৌসুমে) ৬০- ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত। এতে দুটি গরু পুষেই বছরে লাখ টাকা মুনাফা থাকতো। কিন্তু ১০ বছরের মধ্যে গো-খাদ্যের দাম ৬-৭ গুণ বেড়ে যাওয়ায় দৃশ্যপট পাল্টে গেছে।
খামার মালিকরা জানান, ১০ বছর আগে এক কেজি গমের ছাল ছিল ৮-১০ টাকা কেজি। এখন সেই গমের ছাল প্রতি কেজি ৬০-৬২ টাকা। এখন এক মণ খেসারি ভুসির দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। যে ভুসি আগে খামরিরা কিনতেন না। এক মণ খড়ের দাম এখন ৫শ’ টাকা। সেই খড় আবার ৩০-৩২ কেজিতে মণ ধরা হয়। সে হিসাবে ১ কেজি খড়ের দাম ১৫ টাকা।
বেশ কিছু খামারি জানান, ভুসির দাম চালের চেয়ে বেশি হওয়ায় গরুকে ভাত খাওয়ানো হচ্ছে। এতে তাদের গরু প্রতি খাদ্যমূল্যের হিসেবে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।
Advertisement
তারা জানান, বাজারে বেশিরভাগ ভুসিতে ভেজাল মেশানো হয়। তারা এসব গো-খাদ্যের বদলে ভাত খাওয়াচ্ছেন। এছাড়া প্রতি কেজি গমের ভুসির যে দাম তাতে মোটা চাল কম দরে কেনা যায়।
সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের রতন কুমার সরকার জানান, তার খামারে ৩০টি গরু রয়েছে। আগে প্রতি বছর পাঁচ-ছয় লাখ টাকা লাভ থাকতো। এখন গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় লাভ খুব কমে এসেছে।
ফরিদপুর উপজেলার পার-ফরিদপুর গ্রামের খামারি আবু বাছেদ জানান, খৈল-ভুসির দোকানে সারা বছর প্রায় ৫০ হাজার টাকা বাকি পড়ে থাকে।
হাটুরিয়া জগন্নাথপুরের প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি মোমিন মোল্লা জানান, তার সমিতির বেশিরভাগ সদস্য দেনার ভারে জর্জরিত।
সাঁথিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের মো. জালাল মাস্টার জানান, তিনি বছরে দু-তিনটি করে গরু পালন করেন। গত ১০ বছরের ব্যবধানে গরু পালন করে লাভ বলতে কিছু থাকছে না বা খুবই কম লাভ হচ্ছে।
Advertisement
তিনি জানান, মোট খরচ হিসাব করলে আসলে লাভ থাকে না। ছোট চাষিরা দু-একটি গরু পালন করেন বলে তাদের রাখাল রাখতে হয় না। তাই খরচ কম হয়। কিন্তু তাদের নিজেদের তো ঠিকই শ্রম দিতে হয়। সেই শ্রম হিসাবের খাতায় ধরা হয় না। আবার দিন দিন অল্প অল্প করে খাবার কেনায় তা ঠিকমতো লিখে রাখা হয় না। এতে ক্ষুদ্র চাষিরা বছর শেষে একটা ভালো দাম পেয়ে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা লাভবান মনে করেন। কিন্তু তাদের মোট শ্রম আর খরচ যোগ করলে লাভ খুবই কম থাকে।
তিনি জানান, তিন বছর আগে যে ভুসি ছিল ২৮-৩০ টাকা কেজি, সেই ভুসি এখন ৬০-৬২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আবার বছর দশেক আগে দুটি গরু পালন করে লাখ টাকা লাভ থাকতো। এখন সেটা আর হচ্ছে না। এছাড়া বাছুরের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে যে বাছুর ৫০-৬০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা যেত এখন তা এক লাখ ২০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। এখন দেড় মণ ওজনের একটা বাছুর কিনতে হচ্ছে ৬০ হাজার টাকায়। এতে শুরুতেই বেশি পুঁজি খাটছে। এর সঙ্গে খাবারের দাম যোগ করে বছর শেষে গরু বিক্রির পর দেখা যায় খরচের সমান সমান হয়ে যায়।
Advertisement
পাবনার অন্যতম বে-সরকারি সংস্থা ওসাকার পরিচালক মাজহারুল ইসলাম জানান, তারা বিগত প্রায় এক যুগ ধরে গরু মোটা তাজাকরণ প্রকল্পে গ্রামের মানুষের মধ্যে ঋণ দিচ্ছেন। এখন তাদের সদস্যদের মধ্যে গরু পালনের জন্য ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ার বদলে কমে গেছে। গরু পালনে খরচ বৃদ্ধির কারণে এটি হচ্ছে বলে তাদের ধারণা।
তিনি জানান, এখন বাছুরের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা আগে ৩০ হাজার টাকা ঋণ দিতেন আর এখন তারা দিচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মন্ডল জানান, এখন সমস্যার মধ্যে শুধু গো-খাদ্যের উচ্চমূল্য। এ ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে তাদের কিছু করার নেই। তবে ভারতীয় গরু আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় চাষিদের বাজারে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে না। খামারিরা মোলাসেস, দানাদার খাবার, কাঁচা ঘাস, খড় খাইয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে তাদের গরু হৃষ্টপুষ্ট করেছেন। আর পাবনা জেলায় অনেক গোচারণ ভূমি থাকায় চাষিরা মাঠে গরু চরাতে পারেন।