ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ০২ মে ২০২৩ : একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের অংশ হিসেবে কফিনটি জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার দেওয়ার রীতি রয়েছে । সম্প্রতি টাঙ্গাইলে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আলমের নেতৃত্বে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, নারীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রতি ‘অসম্মান’; এমনকি এ জন্য ইউএনওর প্রত্যাহার চেয়েছেন তিনি। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী একজন বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সর্বোচ্চ খেতাব বীরশ্রেষ্ঠপ্রাপ্ত সাতজনই শহীদ। কাজেই জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেওয়া সর্বোচ্চ খেতাব বীরউত্তম। উপরন্তু বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকীই বীরউত্তম খেতাব পেয়েছেন। এ বিরল রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে এহেন দায়ত্বহীন আচরণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। নারী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গার্ড অব অনারে মুক্তিযোদ্ধা কীভাবে অসম্মানিত হলেন?
(বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু: নারী ইউএনও দিয়ে গার্ড অব অনারে কাদের সিদ্দিকীর বাধা)
রোববার সমকালে প্রকাশিত কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য অনুযায়ী, দেশটা নিয়ন্ত্রণে চললে নাকি ‘এমন বেয়াদব তৈরি হতো না।’ কাদের সিদ্দিকী দেশে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন– পরিষ্কার নয়। তিনি কি আফগানিস্তানের মতো নিয়ন্ত্রণ চাচ্ছেন, যেখানে পুরো দেহ অতিরিক্ত কাপড়ে আবৃত না হয়ে নারীরা রাস্তায় বের হতে পারেন না; এমনকি নারীদের কোনো পুরুষের সঙ্গে চাকরি তো নিষিদ্ধই; শিক্ষাদীক্ষাও চলে না? গার্ড অব অনারের প্রসঙ্গ টেনে ইউএনওকে বেয়াদব বলাটা রুচিশীলতার পরিচয় হতে পারে না। ইসলামী শরিয়তে গার্ড অব অনার বলে কিছু আছে কিনা, আমার জানা নেই। গার্ড অব অনার এবং জানাজা আলাদা বিষয়। নারী ইউএনও জানাজায় অংশ নেননি। তিনি শুধু রাষ্ট্রীয় রীতি অনুযায়ী গার্ড অব অনার দিয়েছেন। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, কাদের সিদ্দিকী গার্ড অব অনার ও জানাজাকে এক করে বক্তব্য দিয়েছেন। মেয়ে যত বড়ই হোক, তাঁর যে জানাজায় অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই– এটি জানা কথা। কিন্তু নারী ম্যাজিস্ট্রেট গার্ড অব অনার দিতে পারবেন না; বা দিলে মুক্তিযোদ্ধা অসম্মানিত হবেন– এটি কোন কিতাবে লেখা আছে?
প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেতা নারী। স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদ উপনেতা নারী। সরকারি চাকরিতে পুরুষের সমানসংখ্যক নারী না থাকলেও ক্রমান্বয়ে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। গত মার্চ মাসের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে কর্মরত ইউএনর ৩৪ শতাংশ নারী। অর্থাৎ সংখ্যাটি ১৬০-এর বেশি। ৬৪ জেলার মধ্যে ১০টিতে নারী ডিসি কর্তব্যরত। ৭৯ সচিবের মধ্যে ১০ জন নারী। জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য রয়েছেন। এর বাইরে বেশ কয়েকজন সরাসরি নির্বাচিত সদস্য; এমনকি মন্ত্রীও রয়েছেন। সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সাচিবিক সহায়তা দেওয়া প্যানেলেও একজন নারী উপবিষ্ট থাকেন। এসব কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বেশ প্রশংসিত। কাদের সিদ্দিকী কি তা থামিয়ে দিতে চান?
মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গেই উচ্চারিত হবে। কিন্তু নারী কর্মকর্তার গার্ড অব অনার বিষয়ে তাঁর অসৌজন্যমূলক বক্তব্য জননেতা হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোকে মৌলবাদী চক্র সমর্থন করে না। এসব কর্মকাণ্ডকে শরিয়তবিরোধী আখ্যায়িত করেই তারা এসব বন্ধের দাবি জানায়; কাদের সিদ্দিকীকে যদি ওই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা কি শোভন হবে?
আলোচ্য ঘটনা দেখিয়ে দিল– পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নানারূপে সমাজে বিরাজমান। পুরুষতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়া আপসারিত না হলে নারীর ক্ষমতায়ন পূর্ণতা পাবে না। নারীদের শুধু চেয়ারে বসিয়ে বাহবা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাঁদের সম্মান ও কর্মপরিবেশ তৈরি করে দেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।