ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি,বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩ : রাতে হলের গেস্টরুম ডেকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে থাপ্পড় মেরে কান ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের দুই সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে।
Advertisement
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ ফরিদ এবং ইতিহাস বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান। ছাত্রত্ব শেষ হলেও তারা অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার (২১ মার্চ) রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে গেস্টরুমে এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সজীব আহমেদ। সজীব বলেন, ‘ঝামেলাটা শুরু হয়েছিল বহিরাগত একজনের সঙ্গে। সে আমাদের বড় ভাইদের গেস্ট ছিল। এ ঝামেলার কারণে আমাদের গেস্টরুমে ডেকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নাঈম (রসায়ন ৪৮), সিয়াম (প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ-৪৮) ও আমার কানে ইচ্ছামতো মারার চেষ্টা করা হয়। আমি কানে হাত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করলে হাত সরিয়ে মারধর করেছেন ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের ফরিদ ভাই। আমি অসুস্থ হলে শুয়ে পড়ি, কিন্তু তারা আমাকে বসতেও দেই নাই। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে যেতে দেয় নাই। আমি নাটক করছি বলে আমাকে লাথি দেওয়ার চেষ্টা করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মোস্তাফিজুর রহমান ভাই।’
ভুক্তভোগী আরও বলেন, ‘আমাকে জাবি মেডিকেলে নেওয়া পর ডাক্তাররা এনাম মেডিকেলে সুপারিশ করলে ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে হলের বড় ভাইয়েরা আমাকে যেতে দেইনি। পরে বন্ধুরা জোর করে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, আমার কানের পর্দা অনেকটা ফেটে গেছে। একমাস পরে জানা যাবে সেটি পুরোপুরি সারিয়ে উঠবে কি না।’
Advertisement
লিখিত অভিযোগ দেওয়ার বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘তারা ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাদের কারোরই ছাত্রত্ব নেই। কার কাছে অভিযোগ দেবো?’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, রাত সাড়ে ১১টায় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল রাজিসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সাভারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার সুপারিশ করেন।
এদিকে সাভারের এনাম মেডিকেল হাসপাতাল থেকে দেওয়া একটি প্রেসক্রিপশন জাগো নিউজের কাছে এসেছে। এতে ভুক্তভোগী সজীবকে তিনমাস কানে পানি না ঢুকানো, কানে তেলেভেজা তুলা দিয়ে গোসল করা এবং পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
হল সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (২১ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দিবেন্দু দিব্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। পরে তাকে হলের গেস্টরুমে তুলে এনে মারধর করেন তারা। রাবি ছাত্রলীগের ওই নেতা জাবি ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আলরাজি সরকারের পরিচিত হওয়ায় হলের সিনিয়দের নিয়ে মিটিং হয়। মীমাংসা শেষে দিব্য ক্ষমা চেয়ে চলে যাওয়ার সময় হলের জুনিয়র কর্মীরা আবারও মারধর করেন। এ ঘটনাসহ হলের অন্যান্য ঘটনা নিয়ে রাত সাড়ে ৮টায় গেস্টরুম শুরু হয়। চলে রাত ১টা পর্যন্ত।
Advertisement
গেস্টরুমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রসায়ন বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, মার্কেটিং বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ পরান, একই বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজি সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, গেস্টরুম চলাকালীন রাত আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটে ভুক্তভোগী সজীবের কানে এলোপাতাড়ি চড় মারেন ফরিদ। এতে সজীবের কান ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। সজীব কান্না করতে শুরু করলে ক্ষিপ্ত হয়ে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান বলেন, ‘সে নাটক করতেছে। ওরে তোল। আজকে এই গেস্টরুম থেকে ওর লাশ বের হবে।’
পরে সজীবকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে যাওয়ার সময় হল গেটে বাধা দেন ইমরান। জুনিয়রদের শাসিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে দেখ সে নাটক করতেছে কি না। ২০-৩০ মিনিট অবজার্ভ কর। তারপরে মেডিকেলে নিয়ে যা। আর এখন মেডিকেলে নিয়ে গেলে নিউজ হবে। তখন আমরা বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারবো না।’
অভিযুক্ত হাসান মাহমুদ ফরিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত গেস্টরুম চলছিল। এমন সময় কানের সমস্যার কারণে সজীব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন কয়েকজন তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।’
অভিযুক্ত ইমরান বলেন, ‘রোজা এবং ইফতার নিয়ে আমাদের গেস্টরুম চলছিল। এসময় সবার সামনে সে (সজীব) শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি।’
অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন গেস্টরুমের বিষয়টি স্বীকার করলেও মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন।
Advertisement
অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযুক্ত আল রাজি সরকার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান।
অভিযুক্তরা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি জেনেছি। ভুক্তভোগীকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। হলের অন্যান্য শিক্ষকদের নিয়ে বসে প্রকৃত ঘটনা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’