ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম(টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি, শুক্রবার, ০৩ মার্চ ২০২৩ : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটক করা হয়। বহুল আলোচিত ওই ঘটনায় পানি গড়িয়েছে বহুদূর। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য ওই অস্ত্র আনা হয়েছিল–প্রথমে এমন তথ্য জানানো হলেও, পরে জানা যায়, ওই অস্ত্রের চালানের ভাগ যাওয়ার কথা ছিল জামায়াতে ইসলামীর কাছেও। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে দমন করা। আর এসবের নেপথ্যে ছিলেন বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠরা।
Advertisement
সম্প্রতি সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সে সময়কার উপ-পরিচালক গগনজিৎ সিং।
দেশের অর্থনীতির আবর্তন অনেকটাই বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ঘিরে। প্রতিদিন শত শত জাহাজ ভেড়ে বন্দরটিতে। হাজারো মানুষের আনাগোনায় মুখর থাকে দিনরাত। তাই দৃষ্টি এড়াতে কর্ণফুলী নদীর তীরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংরক্ষিত চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার জেটিকে অস্ত্র খালাসের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়।
যদিও এর আগে থেকেই ভারতের সশ্রস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর নেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায় বাংলাদেশে। ২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল রাত পৌনে ১১টার দিকে সিইউএফএল জেটিতে মাছ ধরার দুটি ট্রলার থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য ঘাটে উপস্থিত ছিলেন শীর্ষস্থানীয় এক উলফা নেতা। কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যপটে হাজির হন পুলিশের দুই সার্জেন্ট। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ওই উলফা নেতার বাগ্বিতণ্ডা। একপর্যায়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই ধরা পড়ে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান।
Advertisement
এসব অস্ত্র আটকের মাস চারেক আগে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের একটি হোটেলে বৈঠক হয় পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীনের প্রধান সালাউদ্দিন ও উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার। সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটের নাকের ডগায় হওয়া ওই বৈঠকের খবর পান ভারতীয় গোয়েন্দারা।
সে সময় উলফার গতিবিধি নজরে রাখার দায়িত্বে ছিলেন ভারতের সামরিক গোয়েন্দা শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর গগনজিৎ সিং। তিনি সময় সংবাদকে জানান, বৈঠকের খবরটি বাংলাদেশকে জানানো হলেও নীরব ছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
গগনজিৎ বলেন, ‘আমরা জানতে পারি ওখানে (চট্টগ্রামে) একটি বৈঠকে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনের নেতারা আসছে। আমাদের সরকার খুব সতর্ক ছিল এবং এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিল। বলা হলো, বৈঠকে কী হতে যাচ্ছে তা জানাতে। যে কারণে আমরা নজর রাখছিলাম।’
Advertisement
জানা যায়, অস্ত্র আটকের আগ থেকেই চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন পরেশ বড়ুয়া। আটকের দিনও সিইউএফএলের খুব কাছে ছিলেন তিনি। সবকিছু জেনেও নিশ্চুপ ছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তবে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও অস্ত্র আটকে বাধ্য হয় বেগম জিয়ার সরকার।
ভারতের সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা গগনজিৎ জানান, অস্ত্রের চালানের জন্য ডিজিএফআই, এনএসআইকে ব্যবহার করেছে বিএনপি-জামায়াত; যার নেপথ্যে ছিলেন তারেক রহমান এবং হাওয়া ভবনে তার ঘনিষ্ঠজনরা।
গগনজিৎ সিংয়ের ভাষ্য, ‘যখন আমরা দেখলাম উলফা নেতা, এনডিএফবি নেতা ও ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী ছোট সংগঠনের নেতাদের বাংলাদেশে আনাগোনা বাড়ছে; সুতরাং এটা বলা যায় ষড়যন্ত্র হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতরে। তাদের সুরক্ষা দেয়ার নেপথ্যে তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য ছিল পার্শ্ববর্তী দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা অথবা বাংলাদেশের তখনকার বিরোধী দলকে দমন করা। আমি সে সময়কার ডিজিএফআইকে দায়ী করছি না। কারণ, ডিজিএফআই সরকারের নির্দেশে কাজ করেছে। সরকার যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়, তারা সেভাবে কাজ করে। অস্ত্র চোরাচালানের নেপথ্যে জঙ্গি সংগঠন এবং জামায়াত জড়িত ছিল। সরকার শুধু তাদের ওপর নজর রেখেছে।’
সে সময় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অনুপ চেটিয়া। একাধিকবার গণমাধ্যমের সামনে তিনি স্বীকার করেছেন, অস্ত্রের চালানের নেপথ্যে বিএনপি সরকারের মদতের কথা। গগনজিৎ সিংয়ের মতে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার করতে অস্ত্রগুলো আনা হয়। শুধু উলফা নয়, জামায়াতকেও অস্ত্রের ভাগ দেয়ার কথা ছিল। জামায়াতকে অস্ত্র দেয়ার পরিকল্পনার উদ্দেশ্যই ছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘অস্ত্রের বিরাট একটি অংশ জামায়াতকে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। বাকি অংশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে দেয়া হতো।’
বিএনপির আমলে অস্ত্রের চালান আটক হয় এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি জেটি কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা নজর এড়িয়ে এতবড় চালান ঢোকা একেবারে অসম্ভব, যার উত্তর মিলেছে আদালতে।
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অস্ত্রের চালান আসার বিষয়টি জানতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী। জানতেন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। অস্ত্র আটকের বিষয়টি জেনেও নীরব ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।