ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ৪ বছর আজ। ২০১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় আজও কেঁদে চলছে স্বজনহারা পরিবারগুলো। নিহতদের স্মরণে প্রতিবছর চুড়িহাট্টার অগ্নিকূপ ওয়াহেদ ম্যানশন-এর সামনে এসে জড়ো হন স্বজনরা। ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। যেসব কেমিক্যাল গোডাউন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় এখনো সরেনি। আগুনে পোড়া ওয়াহেদ ম্যানশন দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই এখান থেকেই চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির সূত্রপাত। ওয়াহেদ ম্যানশন এবং এর আশপাশের ভবনের গুদামগুলো আগের মতোই ঠাসা বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালে। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার চার বছর পূর্তিতে সরজমিন দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। আগুনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেনি এলাকাবাসী এবং স্বজনহারা পরিবারগুলো। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের পর নিহতদের স্বজন ও স্থানীয়দের চুড়িহাট্টাসহ পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন, কারখানা সরিয়ে নেয়ার দাবি জোরদার হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
Advertisement
বরং এ বিষয়ে কথা বলে হুমকির মুখে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ নিহতদের স্বজনরা। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. হাসেম বলেন, আমি এখনো দেখতে পাই কীভাবে চোখের সামনে মানুষগুলো অসহায় এবং নির্মমভাবে পুড়ে মরেছে। আমার পরিচিত একাধিক ব্যক্তি এ ঘটনায় নিহত এবং আহত হয়েছেন। ঘটনার পর থেকেই আমরা এলাকার ভবন ও গোডাউন মালিকদের কেমিক্যাল সরিয়ে নিতে অনুরোধ করি। পরবর্তীতে তারা উল্টো আমাদেরকে এলাকা ছাড়া করার হুমকি প্রদান করে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও নিহতদের স্বজনরা গত রোববার থেকেই ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশে হাজির হয়। কেউ কেউ তাদের স্বজনদের নামে ব্যানার নিয়ে স্মরণ করেন। কিন্তু পরিস্থিতি সেই আগের মতোই রয়েছে। কিছু বদলায়নি। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় প্রবেশ করে ওপরে যেতে চাইলে প্রবেশদ্বার বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় এক হোটেল কর্মচারী জানান, ওয়াহেদ ম্যানশনসহ এর আশপাশে সর্বত্রই খোঁজ করলে কমবেশি কেমিক্যাল গোডাউনের সন্ধান মিলবে। কেউ লুকিয়ে, কেউ আবার প্রকাশ্যেই কেমিক্যাল গুদামজাত করছে। পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা এ রকম কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে ফেলার তাগিদ দিলেও ব্যবসায়ীরা কর্ণপাত করছে না।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতি ঝুঁঁকিতে থাকা ১ হাজার ৯২৪ জন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও গোডাউনের তালিকা করে এদের সরিয়ে নিতে টাস্কফোর্স সুপারিশ করলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এ পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকা শতভাগ অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস সূত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে এবং সিটি করপোরেশনে দায়িত্বরতদের ম্যানেজ করে অন্য ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তা দিয়ে চালানো হচ্ছে কেমিক্যালের ব্যবসা। কৌশল হিসেবে পুরান ঢাকার এসব ভবনের সামনের দিকে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন মনোহরি পণ্য সাজিয়ে রেখে ভবনের পেছনের দিকে লুকিয়ে গুদামজাত করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে নিজস্ব সিন্ডিকেটের আওতায় থাকা এবং বিশ^স্ত অসাধু জানাশোনা ব্যবসায়ীদের কাছেই এসব কেমিক্যাল গোপনে বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কর্তাব্যক্তিরা দেখেও না দেখার ভান ধরে ম্যানেজ হয়ে আছেন বলে জানা গেছে। এ সকল অসাধু কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইন্সেস প্রদানকারী একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার এর মতো কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। ১৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে সরাসরি বাসা-বাড়িতে। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে।
Advertisement
এদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কেমিক্যাল গুদামজাত করনের ফলে পুরান ঢাকাবাসী শতভাগ অগ্নিঝুঁঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকা এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, পুরান ঢাকা এখনো শতভাগ অগ্নিঝুঁকিতে। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করেও ব্যর্থ হয়েছি। বিশেষ করে নাজিরাবাজারসহ ওখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এর কারণে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো গোপনেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিসহ বড় দুর্ঘটনাগুলোর কারণ হচ্ছে তথ্য গোপন করে কেমিক্যাল ব্যবসা করা। এতগুলো মানুষের জীবনের বিনিময়েও আমরা সচেতন হচ্ছি না।