ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : ২০০৪ সালের চট্টগ্রামে জব্দ দশ ট্রাক অস্ত্র সম্পর্কে জানতো সেই সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। জেনে শুনেই তারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার এই অস্ত্র বাংলাদেশে খালাসের ব্যবস্থা করেছিলো।
Advertisement
শুধু তাই নয়, হবিগঞ্জ, হালুয়াঘাট, শ্রীমঙ্গল এবং ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় উলফার ক্যাম্প গড়ায় বিএনপি-জামায়াত সরকারের নীরব সমর্থন ছিলো। একাত্তরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া।
২০১৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও উলফার মধ্যে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন অনুপ চেটিয়া। ওই বছরই বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করে।
বাংলাদেশে দীর্ঘ কারাভোগের পর নিজ দেশে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ঘোষণা দেন অনুপ চেটিয়াসহ দলটির সব নেতা কর্মী। উলফা পরিণত হয় একটি সামাজিক সংগঠনে। বিনিময়ে অনুপসহ দলটির নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করে দিল্লি।
দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকার কারণে এদেশেই ছিলো অনুপ চেটিয়ার পরিবারের সদস্যরা। এই তথ্য অনেকেরই অজানা যে, পরিচয় গোপন রেখে তাঁর মেয়ে বন্য চেটিয়া ও এক ছেলে পড়াশুনা করতো বাংলাদেশেই।
Advertisement
তখনই বন্য চেটিয়ার সাথে তার এক সহপাঠির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২২ সালে তাদের বিয়ে হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। তবে বন্য এখন বাংলাদেশেই থাকেন। ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রায়ই মেয়ের কাছে বেড়াতে আসেন অনুপ চেটিয়া।
সম্প্রতি মেয়ের বাসায় এলে একাত্তরের সাথে মুখোমুখি সাবেক বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া। সেই আলাপচারিতায় উঠে আসে অনেক তত্য। জানান তার গেরিলা জীবনের অজানা নানান কাহিনীও।
অনুপ চেটিয়া বলেন, ২০০১ সালের পর জামাত বিএনপি জোট সরকারের সময় থেকে হবিগঞ্জ জামালপুরের হালুয়াঘাট, শ্রীমঙ্গল, শেরপুর ও ঝিনাইগাতীতে উলফার বেশ কয়েকটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। তিনি জানান, এরাশাদের শাসনামলের শুরুর দিকে তিনি এদেশে আসেন।
বাংলাদেশে আসার পর অনুপ চেটিয়া ব্যবসায়ীর পরিচয়ে ঢাকাতেই থাকতেন। শুরু দিকে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন জন ডেভিড সোলায়মান হিসাবে। নিজেকে খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠির লোক হিসাবে বর্ণনা করতেন। আর গ্রেফতার হবার সময় তিনি মোহাম্মদপুরের আদাবরে থাকতেন।
অনুপ বলেন, স্বপরিবারে ঢাকাতে বসবাস শুরু করার পর ছেলে-মেয়ের পরিচয় গোপন করে তাদের পড়াশুনা করাতে হতো। মুসলিম পরিচয়ে মেয়ে বন্য ও ছেলে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছে। শেষ দিকে তারা মাস্টারমাইন্ড স্কুলে পড়াশুনা করেছে।
ভারতের নিষিদ্ধ সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) প্রতিষ্ঠাতা অনুপ চেটিয়া জানান, কারাগারে বন্দী থাকার সময়ে তাঁর মেয়ে বন্যা রাজধানী ঢাকার মাস্টারমাইন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তেন। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী অনির্বাণ চৌধুরী। সেখানেই তাঁদের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান তারা। এরপরই বিয়ে করেন তারা।
অনুপ চেটিয়া দাবি করেন, বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তাদের ঘাঁটি সম্পর্কে সব জানতো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তিনি জানান, উলফা অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া ও অরবিন্দসহ অনেকেই বাংলাদেশে থাকতো এবং সরকার সেটি জানতো।
অনুপ চেটিয়া বলেন, ২০০৭ সালের ওয়ান ইলিভেন সরকার আসার আগ পর্যন্ত তারা উলফার কার্যক্রম ভালোভাবেই পরিচালনা করতেন এবং সরকারের কাছ থেকে কোন ধরনের অসুবিধার মুখোমুখি হননি। তিনি বলেন, এদেশে উলফার ঘাঁটি সম্পর্কে সব কিছুই জানতো সরকার।
তিনি জানান, বাংলাদেশে অবস্থিতি উলফার ঘাঁটি ব্যবহার করে অস্ত্র চালান আনা নেয়া করার কোন পরিকল্পনা তাদের প্রথমে ছিলো না। অনুপ চেটিয়া দাবি করেন, ২০০৪ সালে চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক ট্রাক অস্ত্র চালানের ঘটনা সম্পর্কে বিএনপি-জামায়াত সরকার সব জানতো।
বাংলাদেশে কে বা কারা উলফার সাথে সম্পৃক্ত ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে কিছু পরিবার ছিল যাদের আত্মীয়-স্বজন আসামে ছিল। আসাম থেকে এখানে মাইগ্রেট হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল। অল্প কিছু পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশি কারোর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
Advertisement
অনুপ চেটিয়া বলেন, আসামের চা বাগান থেকেই উলফার জন্য নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করা হতো। প্রতি কেজি চা পাতা থেকে দশ পয়সা বরাদ্দ থাকতো উলফার জন্য। আর সেই অর্থ দিয়েই তারা আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারিদের কাছে থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতেন।
তবে এখন উলফা সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। তারা কাজ করছে আসাম ও বাংলাদেশের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে। তবে, বাংলাদেশের গেলো এক দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিস্মিত করেছে সাবেক এই উলফা নেতাকে।
জীবনের দীর্ঘ সময় গেরিলা সংগ্রামে কাটিয়ে দেয়া অনুপ চেটিয়ার সবশেষ উপলব্ধি, অস্ত্র ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠার যুগ আর নেই। তিনি একাত্তরকে বলেন, বর্তমানের বিশ্বে যে কোন সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকানোর উদ্দেশে ১৯৭৯ সালে আসামের শিবসাগর জেলায় গঠন করা হয় ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম–উলফা। এ সংগঠনে সে সময় দাবি করে, অবৈধ অভিবাসীদের কারণে আসামে আদিবাসীরা সংকটে ও সমস্যার মধ্য পড়ছেন। এ জন্য তারা উলফা গঠন করেছেন।
এর পরে, আসামে ভারতে সেনাদের অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন অনুপসহ উলফার শীর্ষ নেতারা। বাংলাদেশে ক্যাম্প স্থাপন করে আসামে কার্যক্রম চালায় উলফা। অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে প্রায় ২৮ বছর ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ি থেকে অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৫ সালে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া।
এদিকে অস্ত্র উদ্ধারে কর্ণফুলী থানায় দুটি মামলা হয়। সিআইডি পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। এর বিচারও একসঙ্গে শুরু হয়।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা দুটির অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
চোরাচালানের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে এই সর্বোচ্চ সাজা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অস্ত্র আইনে করা মামলায় আসামি ছিলেন ৫০ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ সংক্রান্ত দুটি মামলার মধ্যে একটিতে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
তাদের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।