প্রতারক চক্রের বিলাসী জীবনের নেপথ্যে

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ; খাদ্যপণ্যের ডিলারশিপ ও সেল্‌সকর্মী নিয়োগের কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। চক্রটি জাতীয় পত্রিকা ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসায়ী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। যোগাযোগের জন্য অফিসের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিতো। আগ্রহীরা ফোন করলে তাদের অফিসে আসার আমন্ত্রণ জানাতো চক্রের সদস্যরা। উন্নত ডেকোরেশন ও দামি ফার্নিচারের অফিস দেখে অনেকেই খুব দ্রুত ডিলারশিপ নিতে রাজি হয়ে যেতো। চাকরি প্রত্যাশীরাও জামানত দিয়ে চাকরি করতে রাজি হতো। কিন্তু বাস্তবে প্রতারক চক্রটি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ডিলারশিপের চুক্তি ও চাকরি প্রত্যাশীদের চাকরির চুক্তি করার পর জামানতের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যেতো। এক ঠিকানায় কিছু মানুষের সঙ্গে এ রকম প্রতারণা করে ফের নতুন ঠিকানায় গিয়ে নতুন কোম্পানির পণ্যের ডিলারশিপ ও চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিতো।

এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি শ’ শ’ ব্যবসায়ী ও চাকরি প্রত্যাশীদের পথে বসিয়েছে। প্রতারণার এসব টাকা দিয়ে তারা বিভিন্ন স্থানে কিনেছে জমি। আলিসান বাড়ি তৈরি করে বিলাসী জীবনযাপন করে।

Advertisement

অবশ্য রেহাই মিলেনি। এক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর মামলায় চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলো- মো. কবির হোসেন ওরফে জোবায়ের ওরফে আক্তার হোসেন ওরফে আশরাফুল ওরফে রাসেল (৪০), মামুন হোসেন ওরফে বেলাল ওরফে কামরুল (৪০), আবু হাসান ওরফে জামিল হোসেন (২৫) ও আব্দুল্লাহ আল রাব্বী ওরফে রেদওয়ান (২৪)। পল্লবী থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় শনিবার ঢাকার বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে কর্মী ও ডিলারশিপ নিয়োগের জন্য ভুক্তভোগীদের নাম ও ছবি সম্বলিত আবেদনপত্র, কর্মী নিয়োগের ছবিসহ জীবন বৃত্তান্ত, আসামিদের বিভিন্ন পরিচয় সম্বলিত ভিজিটিং কার্ড, কোম্পানির ভুয়া পণ্যের মূল্য তালিকা। ৪টি মোবাইল ফোন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের কপি, পণ্যের নমুনা আলামত, ১টি ল্যাপটপ, সিল-প্যাড। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতারক চক্রের মূলহোতা কবির হোসেন জোবায়ের বরিশালের কাজীরহাট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবনের আশায় এক সময় ঢাকায় আসে।

Advertisement

তারপর বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ও কনজিউমার প্রডাক্টস কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ের চাকরি করে। সেই সুবাদেই মার্কেটিংয়ের নানা কৌশল রপ্ত করে। এই কৌশল প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কবির তার বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে কনজিউমার প্রডাক্টস এর ভুয়া কোম্পানি খোলা শুরু করে। সেই কোম্পানিগুলোতে ডিলার, এরিয়া ম্যানেজার নিয়োগের জন্য পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। ডিবি জানায়, কবির প্রথমে নাবিলা ফুড প্রডাক্ট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি চালু করে। সে নাবিলা ফুড প্রডাক্টসের লেবেল বিভিন্ন কোম্পানির প্রডাক্টে বসিয়ে মিরপুরে একটি ভুয়া পণ্য সমৃদ্ধ সুসজ্জিত চটকদার অফিস স্থাপন করে। সেই অফিসে তার মূল সহযোগী ছিল তার স্কুল জীবনের বন্ধু মামুন হোসেন। মামুনের জনবল সরবরাহের ব্যবসার অভিজ্ঞতা থাকায় সে কবিরকে ডিলার এবং কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা করে তার প্রতারণা কার্যক্রমকে আরও কার্যকরী করে তোলে। তারা দুজনই এ প্রতারণা কাজে ভুয়া নাম ব্যবহার করে। নাবিলা ফুড প্রডাক্টস নামীয় ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ীর কাছে কোম্পানির ডিলারশিপ ও কর্মী নিয়োগের কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে সেই অফিস বন্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে তৃষ্ণা ফুড প্রডাক্ট লিমিটিেড নামে আরেকটি ভুয়া কোম্পানি চালু করে। এবার সে তার সহযোগী হিসাবে মামুনের পাশাপাশি মার্কেটিং ম্যানেজার মো. আবু হাসান ও এইচআর এডমিন হিসেবে আব্দুল্লাহ আল রাব্বীকে নিয়োগ দেয়। তারা দুজনেই সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সাবেক সৈনিক।

Advertisement

সেনাবাহিনীর সৈনিক পরিচয় দিয়ে তারা ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস স্থাপন করতো। এভাবে তারা তৃষা ফুড প্রডাক্ট লিমিটেডের ব্যনারে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এজাহারে মামলার বাদী উল্লেখ করেছেন, গত বছরের ১৮ই মার্চ ফেসবুকের একটি পেজে এবং পরে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় নাবিলা ফুড প্রডাক্ট লিমিটেডের ডিলার এবং কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখতে পেয়ে বিজ্ঞাপনে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন করে কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়োগের বিষয়ে বাদীর কথা হয়। বাদীকে তারা তাদের অফিসে এনে ৩০টির বেশি ভুয়া পণ্য দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে। বাদী ডিলারশিপের চুক্তি অনুযায়ী আসামিদের কথামতো নোয়াখালী অঞ্চলে ডিলারশিপ নেয়ার জন্য সরল বিশ্বাসে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা জমা দেন। একইভাবে দুলাল আহাম্মেদ নামক ব্যক্তি লালমনিরহাটে ডিলারশিপের জন্য ১০ লাখ ৫ হাজার, মোহিনী চন্দ্র রায় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের ডিলারশিপের জন্য ২ লাখ ৪০ হাজার, আওয়াল নামের আরেকজন রংপুর, সাভার ও পাবনা অঞ্চলের ডিলারশিপের জন্য ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। টাকা পাঠানোর একদিন পর থেকেই চক্রের সদস্যরা বাদী ও অন্যান্য ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ভুক্তভোগীরা আসামিদের খোঁজে নাবিলা ফুড প্রডাক্টসের অফিসে গিয়ে দেখতে পান সেখানে কোনো অফিস নাই। পরে তারা খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বাদী আরও উল্লেখ করেন, প্রতারকদের ধরার জন্য খোঁজখবর ও ফেসবুক-পত্রিকায় একই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে সন্দেহ জাগে। পরে তিনি জানতে পারেন একই ব্যক্তিরা নতুন অফিস, নতুন কোম্পানি খুলে ফের প্রতারণা করছে।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ মানবজিমনকে বলেন, কবিরের নেতৃত্বে এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ডিলারশিপ দেয়া ও কর্মী নিয়োগের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের সব কৌশলই খুব পরিকল্পিত ছিল। যে অফিস নিতো সেখানে উন্নত ডেকোরেশন থাকতো। পত্রিকায় টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতো। সেনাবাহিনীতে চাকরির কথা বলে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতো। ডিলারদের কাছ থেকে জামানত নিতো। এক অফিস থেকে এ রকম কয়েকজনের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নেয়ার পর তারা অফিস ও মোবাইল নম্বর বন্ধ করে অন্য জায়গায় গিয়ে আবার ফাঁদ পাততো। এভাবে শত শত মানুষকে তারা ঠকিয়ে পথে বসিয়েছে। তিনি বলেন, প্রতারক কবির হোসেন, মামুন হোসেন, আবু হাসান এবং আদুল্লাহ আল রাব্বী ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কোম্পানির ডিলারশিপ ও কর্মী নিয়োগের কথা বলে হাতিয়ে নেয়া টাকা দিয়ে স্থায়ী এবং অস্থায়ী ঠিকানায় জমি কিনেছে। এসব জমিতে আলিসান বাড়ি তৈরি করে বিলাসী জীবনযাপন করছে। ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদেরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।