পথের ধার থেকে আলম প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থান করেছে নিয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। তাঁর হাতে শিক্ষা যায়নি কিন্তু প্রযুক্তির উন্নত মোবাইল ফোন গেছে। রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি তাঁকে শিক্ষা দিতে অক্ষম হলেও প্রযুক্তির অর্থনৈতিক মুনাফার জন্য মোবাইল তুলে দিয়েছে। তাঁকে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন শিক্ষা দিতে চায়নি; ঘৃণা বা তিরস্কার করেছে। আলম জানেন, উত্তম কুমার নায়ক, নায়ক রাজ রাজ্জাকও নায়ক; সালমান খান, শাহরুখ খানরাও নায়ক। তাঁদের হিরো বলে আখ্যা দেওয়া হয়। আলম তাঁর নামের আগেও জুড়ে দিয়েছেন হিরো শব্দটি।
হিরো আলম নিজের মতো করে রচনা করছেন গান-নাচ; তা-ই প্রচার করছেন ইউটিউবে। কেউ মজা করে, কেউ মজা পেয়ে দিচ্ছে লাইক। ইউটিউব কর্তৃপক্ষ তাতে জুড়ে দিয়েছে বিজ্ঞাপন। হিরো আলমের মাধ্যমে জনগণ পরিচিত হচ্ছে পণ্যের সঙ্গে। আর তা থেকে হিরো আলমও পাচ্ছেন টাকা। এরপর নিজেকে ভাবতে শুরু করেছেন গায়িকা মমতাজের মতো, নাট্যনায়িকা সুবর্ণা মুস্তাফার মতো, চলচ্চিত্র নায়ক ফারুকের মতো। তাঁরা যদি তাঁদের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্য হতে পারেন, তিনি পারবেন না কেন? একটি মস্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন প্রচলিত রাজনীতির সামনে, প্রচলিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যক্তিদের সামনে।
জাতির সংস্কৃতির ওপর আঘাতটা প্রতিহত না করলে এক সময় রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজ পথভ্রষ্ট হতে পারে। এমনটি মুখে বললেও জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষা ও তা সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সংস্কৃতি যখন আত্মসমর্পণ করেছে, অর্থনীতি আর রাজনীতিকে গ্রাস করতে তখন লুটেরা পুঁজির খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সাংস্কৃতিক মান নিচে নেমে আসায় সমাজে আদর্শহীনতা বেড়েছে, বেড়েছে অসহিষুষ্ণতা, ভোগবাদিতা। এর সঙ্গে বিগত দুই দশকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, নানা আঘাত মাঠ পর্যায় থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করে সেখানে স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
Advertisement
ধান ভানতে শিবের গান গাইছি কিনা এমনটি অনেকে ভাবতে পারেন। ভাবা সংগত। হিরো আলম নামে যুবকটির রাজনীতি করার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই সংস্কৃতি, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির সম্পর্কটিই বা কী? সম্পর্ক আছে, সম্পর্ক নেই বললেই ভুল হবে। হিরো আলমের মতো যুবকরা ৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। সেই যুবকরা জীবন দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন একটি সমতাভিত্তিক সমাজরাষ্ট্রের জন্য। যে রাষ্ট্রে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ বসবাস করবে শান্তিপূর্ণভাবে। সেই আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের একক নেতা শেখ মুজিব হলেও একক দল আওয়ামী লীগ নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগই যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মূল দল, তা-ও অস্বীকার করা যায় না। শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের কারাগারে, সে সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নানা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
যুদ্ধের পর সেই বিভাজন হয়েছে আরও তীব্র। লুটপাটে মত্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর একটি অংশ। তা এমন- বাহাত্তরেই গণপরিষদ ও জাতীয় পরিষদের অর্ধশতাধিক সদস্যকে দলটি বহিস্কার করতে বাধ্য হয়; যারা সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ভেতর বাংলাদেশের মূল নেতৃত্বের সবাই নিহত হয়ে দেশ হয়ে গেছে নেতৃত্বশূন্য। প্রথম ১০ বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেক্টর কমান্ডারদের পাঁচজন নিহত হয়েছেন ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে। আর নেতৃত্বশূন্যতার মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচিত করেছে মূল নেতৃত্ব। সেখানে কুক্ষিগত হয়েছে ক্ষমতা। একটি সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা ফেরত এসেছে রাজনীতিতে। রাজনীতিতে সংমিশ্রণ ঘটেছে অনেক উপাদানের। যেগুলোকে ধাপে ধাপে পরাস্ত করে দেশ হয়েছে স্বাধীন, সেগুলোই আবার ধাপে ধাপে পুনর্বাসিত হয়েছে রাজনীতিতে। সাম্প্রদায়িকতা এসেছে, ধর্মান্ধতা এসেছে, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা এসেছে। আর এসবের হাত ধরে নির্বাসিত হয়েছে গণতন্ত্র এবং তা ঘটেছে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে। ঢাকার বাতাস যেমন এখন ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩১৭ দিন বিষাক্ত থাকে, তেমনি জনগণের জন্য গড়ে তুলেছি বিষাক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা। সেই বিষাক্ত রাজনীতি, অর্থনীতির সমাজে বেড়ে ওঠা যুবক আলম সবকিছু তুচ্ছ করে দিয়ে হতে চাইছেন জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি ভোটও পেয়েছেন। তাঁকে ভোট যারা দিয়েছে, তারা প্রকৃত অর্থে একটি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে অসুস্থ ধারার বিরুদ্ধে। হিরো আলম বলছেন তিনি অশিক্ষিত, নিম্ন শ্রেণির মানুষ; আর সে কারণেই শিক্ষিত প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে নির্বাচিত হতে বাধা দিচ্ছে। কারণ, নির্বাচিত হিরো আলমকে নিয়ম অনুযায়ী ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে হবে শিক্ষিত সমাজকে। সুযোগ বুঝে হিরো আলম শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা বলছেন। যে দ্বন্দ্বের কথা যাঁরা বলতেন, সেই সমাজতন্ত্রীরা প্রায় সবাই হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই- হিরো আলম দুর্বল রাজনীতি, অসুস্থ সংস্কৃতি, দিশেহারা বিধস্ত সমাজের ফাঁক গলে হতে চাইছেন ক্ষমতার অংশীদার।
মাঝেমধ্যে সত্য বেরিয়ে আসে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিবের কণ্ঠে তা ভেসেও আসে অকস্মাৎ। ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের কাছে নেই। মঞ্চ ভেঙে সবাইকে নিয়ে তিনি যেমন পড়ে যান, তেমনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও মঞ্চ ছেড়ে চলে যান।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান শ্রেণি মধ্যবিত্ত। এখন হিরো আলম এসেছেন। ভোটের রাজনীতিতে একদিন হয়তো স্থানও করে নেবেন। ভবিষ্যতে আরও অনেকেই আসবে।
বিষাক্ত বাতাসের অসুস্থ জীবনের বহিঃপ্রকাশ হিরো আলম। ভবিষ্যতে আরও হিরো আসবে- সমীকরণ এমনই বলে।