ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বরিশালের বাকেরগঞ্জ প্রতিনিধি,বুধবার , ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ : বরিশালের বাকেরগঞ্জ ভূমি অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোজাম্মেল হক বাকেরের ঘুস গ্রহণের ভিডিও নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে উপজেলাজুড়ে।
এক মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অফিস সহকারী ঘুসের টাকা গুনে কম হওয়ায় আরও এক হাজার টাকা দাবি করতে। এ সময় টাকা কম হওয়ায় ভুক্তভোগীকে অন্যপথ দেখানোর পরামর্শ দিতেও দেখা যায় তাকে।
ভুক্তভোগী নাম না প্রকাশ করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে ২টি নামজারির জন্য অফিস সহকারীর মোজাম্মেল হক বাকেরের কাছে যাই। এ সময় তিনি আমার কাছে ৬ হাজার টাকা ঘুস দাবি করেন। এক হাজার টাকা কম দেওয়ার চেষ্টা করি তাতে তিনি রাজি না হয়ে আরও এক হাজার টাকা দাবি করেন। না হয় অন্যপথ দেখানোর পরামর্শ দেয় তিনি। পরে বাধ্য হয়ে আরও ৫০০ টাকা দিয়ে নামজারি করাতে হয়েছে।
তিনি এ সময় আরও দাবি করেন, একটা নামজারিতে এ অফিস ১ হাজার ১৫০ টাকার বিপরীতে ১০-১৫ হাজার টাকা করেও নিচ্ছেন। এদের কাছে মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ছে।
ঘুসের ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, কে বার কারা ঘুস দেওয়ার সময় ভিডিও করছে আমার জানা নেই। তবে ওই ভিডিও তাদের বলেও তিনি দাবি করেন।
ঘুসের লেনদেনের ভিডিওর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাকেরগঞ্জ ভূমি অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোজাম্মেল হক বাকের।
এসব বিষয়ে রোব ও সোমবার উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে আরও চাঞ্চল্যকর ঘুসের তথ্য মিলে যুগান্তরের প্রতিবেদকের কাছে। ভূমি অফিসের কানুনগো, নাজির সার্ভেয়ার, তহসিলদার, অফিস সহকারী, পিয়ন সবাই ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। নামজারি, মিস কেস, মিস আপিল, সার্ভে রিপোর্ট, চান্দিনা ভিটা, এমপি কেস, খাস জমি বন্দবস্তি, ভিপি খাজনা দাখিলা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ঘুসের কারবার করেন তারা।
অভিযোগে জানা যায়, উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো মো. নজরুল ইসলাম, নাজির মো. নাসির উদ্দিন, সার্ভেয়ার ফোরকান, অফিস সহকারী বাকের, অফিস সহায়ক (পিওন) রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ মিলে গড়ে তুলছেন এক সিন্ডিকেট। তারা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
অভিযোগ ও অনুসন্ধান বলছে, ওই সিন্ডিকেট বছরে কয়েক কোটি টাকা ঘুস আদায় করেন উপজেলা ভূমি অফিসের সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে। ঘুস আদায় তাদের কাছে ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ্য তারা ঘুস আদায় করছে। এ দৃশ্য ভূমি অফিসে গেলেই চোখে পড়ে হরহামেশা।
অনুসন্ধান বলছে, গত দুই বছরে ভূমি অফিসে গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার নামজারি করা হয়েছে। প্রতিটি নামজারিতে ডিসিআর খরচ সরকারি ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও অফিস খরচ বাবদ ৩ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা করে আদায় করেন ভূমি অফিসের ওই সিন্ডিকেটরা।
এর মধ্যে নাজির মো. নাসির উদ্দিন একাই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের নামজারির দায়িত্ব নিয়ে অফিসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তার কাছ থেকে ৪টি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় অফিস সহকারী বাকেরকে। এতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল কমলেও ঘুসের অভিযোগ কমেনি।
চরাদির ইউনিয়নের কাসেম জানান, তহসিলদারসহ সবাইকে খরচ দিয়ে তিনি তার দুটি নামজারি অনুমোদন করেন। কিন্তু ডিসিআরের জন্য গেলে ৬ হাজার টাকা দাবি করায় তিনি আর নামজারি করতে পারেননি।
নিয়ামতি ইউনিয়নের রাম নগরের নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন ১ হাজার ১৫০ টাকার ডিসিআরে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
একই ভাবে রহমগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলামকেও ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ডিসিআর নিতে হয়।
এর মধ্যে এক তহসিলদারের বাবার সঙ্গে ঘুস নিয়ে অফিসেই বাকবিতণ্ডা ঘটে যা গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যন্ত গড়ায়।
নাম না প্রকাশের শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক স্টাফ যুগান্তরকে বলেন, এ অফিসে নামজারি করতেও টাকা লাগে আবার তা ভাঙতেও টাকা লাগে। টাকায় একজনের জমি অন্যজনকে নামজারি করে দিবে। আবার নামজারি ভাঙতেও (১৫০ কেস) টাকা নিবেন জমির মালিকের কাছ থেকে। তিনিও স্বীকার করেন এ অফিসের টেবিল চেয়ারও টাকা চেনেন।
অভিযোগ আছে ১৫০ কেসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও আদায় করছেন কানুনগো নজরুল ইসলাম। একইভাবে এমপি কেসেও হাতিয়ে নিচ্ছেন ১ লাখ পর্যন্ত। এমনকি প্রতিপক্ষকে মোবাইলে কল দিয়ে জানানো বাবদও কানুনগো কল প্রতি ২০০- ৫০০ টাকা আদায় করেন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে।
তার হয়রানির শিকার মহিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি জানান, আমার পক্ষে প্রতিবেদন নিতে কানুনগোকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
প্রকাশ্য ঘুস লেনদেনের ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইজাজুল হক যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়টি আমার নলেজে নেই ,তবে কনফার্ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাধবী রায়।