পদ্মা সেতুর নির্মাণসামগ্রী সাপ্লায়ার হত্যা, নেপথ্যে..

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আইন আদালত প্রতিনিধি,শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ : আড়াই বছর আগে রাজধানীর বনানীতে খুন হন চীনা নাগরিক মি. গাও জিয়ানহু। ক্লুলেসহীন ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় থানা পুলিশের পর দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিবি পুলিশকে। পরে দুই নিরাপত্তাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তারা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মূলত আয়েশি জীবনযাপনের জন্য এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে জানায় আসামিরা।

২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর বনানীর বাসায় খুন হন ওই চীনা নাগরিক। পরদিন তার বন্ধু ঝাং শু হং মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে গুলশান জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ফজলুল হক দুই নিরাপত্তা প্রহরী আ. রউফ ও এনামুল হককে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। মামলাটি ঢাকার ৫ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফাতেমা ফেরদৌসের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ২২ জুন মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। ওই দিন দুই ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষ্য দেন। আগামী ২১ জুলাই মামলাটি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য করা হয়েছে।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। দুই আসামি কারাগারে। ২২ জুন মামলাটিতে দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণকারী দুই ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষ্য দিয়েছেন। ওইদিন এক আসামির আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। আসামি নিজেই ম্যাজিস্ট্রেটদের জেরা করেন। এক পর্যায়ে ওই আসামি আদালতকে বলেন, খুব অত্যাচার করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি শেষ করতে যথাযথ চেষ্টা করছি। আদালত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দোষী হলে আসামিদের সাজা দেবেন। আর নির্দোষ হলে খালাস দেবেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।

মামলা সম্পর্কে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে, মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, বনানীর অভিজাত এলাকার ২৩ নং রোডের ৮২ নং বাসার ৬ বি ও ৫ বি নির্মিত একটি ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতেন মি. গাও জিয়ানহু। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মূলত পাথর ও নির্মাণসামগ্রী পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরে সাপ্লাই করা ছিল তার মূল ব্যবসা। খুনের কিছুদিন আগে তার স্ত্রী-সন্তান বাংলাদেশে আসেন। কিছুদিন থেকে ঘটনার ২০ দিন আগে আবার তারা চলে যান। মি. গাও বাংলা ও ইংলিশে ভালোভাবে কথা বলতে পারতেন না। বাংলাদেশে খুব বেশি লোকদের সাথে তার চলাফেরা ছিল না। ড্রাইভার সুলতান, দোভাষী হাসিব, সাবেক ম্যানেজার রাজীব এবং বন্ধু এরশাদ উদ্দিন বাদে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না তেমন কোনও বাংলাদেশির সাথে। তার ব্যবসায়িক চীনা বন্ধু মিস চিচি ছাড়াও বেশ কয়েকজন ছিলেন ঘনিষ্ঠ। ভিকটিম প্রায় এক বছর ওই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। চিচির মাধ্যমে তিনি ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন।

চার্জশিটে বলা হয়, আসামি আ. রউফ ও এনামুল হক সুবাস্তু মাহবুবায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিল। চাকরিতে এসে তাদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা হাউজে বসবাসরত বিত্তবানদের জীবনযাত্রা দেখে আর নিজেদের দৈন্যদশা দেখে হতাশাগ্রস্ত হয় এবং নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় কীভাবে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়, সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করতে থাকে। এক পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েকদিন আগে রউফ প্রস্তাব দেয়, হাউজে বসবাসরত চীনা নাগরিক মি. গাও বস অনেক বড় ব্যবসায়ী। সে তার ব্যাগে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে আসা যাওয়া করে। ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। তাকে হত্যা করে যা নিতে পারবো তা দিয়ে তাদের জীবনে কিছু করতে পারবে। তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। তারা নিশ্চিত হয়, ভবনের সিসি ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ড হয় না।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর একবার তারা মি. গাও’কে হত্যার চেষ্টা করে। সন্ধ্যার দিকে ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা না খুলায় তারা ফেরত আসে। এরপর ১০ ডিসেম্বর একে অপরকে বলে, আজকেই কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এনামুল নিজের গামছা সাথে নিয়ে যায়। মাগরিবের আজানের পরই তারা মি. গাও’র ফ্ল্যাটের সামনে যায় এবং রউফ কলিংবেল চাপ দেয়। মি গাও দরজা খুলে তাদের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকায়। ইশারায় জানতে চান, কী বিষয়? তখন এনামুল বলে ওয়াটার ওয়াটার। মানে বুঝাতে চায় পানি খাবে। তাৎক্ষণিক দরজা ধাক্কা দিয়ে তারা বাসায় ঢুকে পড়ে। এনামুল গামছা মি. গা’র গলায় পেঁচিয়ে ধরে। রউফ তার কোমর জাপটে ধরে। মি. গাও ধস্তাধস্তি শুরু করলে রউফ গামছার ওপর দিয়ে চেপে ধরে। একপর্যায়ে মি. গাও রউফের বৃদ্ধাঙ্গুলে কামড় দেয়। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে মি গাও’র নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ২/৩ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। বাসা থেকে ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা এবং মোবাইল ফোন নিয়ে তারা তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে মি. গাও’র মৃতদেহ ড্রয়িং রুমে নিয়ে গামছা দিয়ে রক্ত মুছে দিয়ে ছাদ দিয়ে চলে যায়। পরে গামছা ধুয়ে গোসল শেষে তারা দুজন এক সাথে বের হয়ে যায়। বাড়ির পাশে ড্রেনের সামনে গিয়ে মোবাইল ফোন ভেঙে ড্রেনে ফেলে দেয়। পরে টাকা ভাগ করে নেয়। রউফ নেয় এক লাখ ৭৬ হাজার এবং এনামুল নেয় এক লাখ ৭৩ হাজার টাকা।

চার্জশিটে বলা হয়, ইতোমধ্যে সিকিউরিটি সুপারভাইজার এনামুলকে মুসকান প্রজেক্টে ডিউটিতে যেতে বলে। রাত ৯টার দিকে সে ডিউটিতে চলে যায়। রউফ স্বাভাবিকভাবে নিচে ঘোরাফেরা করছিল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ডিউটিতে নিয়োজিত হয় রউফ আর জয়নন্দী। তখন রউফ সিদ্ধান্ত নেয় মি. গাও’র লাশ গুম করতে হবে। আশপাশে ঘুরে বিল্ডিংয়ের পেছনের দিকে জায়গা নির্ধারণ করে। এই কাজে সহযোগিতার জন্য জয়নন্দীকে ১০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জয়নন্দী প্রস্তাবে রাজি হয় না। তবে জয়নন্দী আশ্বস্ত করে, সে বিষয়টি কাউকে জানাবে না। ১১টার দিকে রউফ জয়নন্দীকে ওষুধ খাওয়ার কথা বলে বিল্ডিংয়ের পেছনে গিয়ে ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে গর্ত করে। পরে মি. গাও’র লাশ বাসা থেকে এনে মাটি চাপা দেয়। উঁচুনিচু মাটি সমতল করার জন্য বালতির মাধ্যমে পানি দিয়ে ভিজিয়ে সমতল করার চেষ্টা করে। পরে সে ডিউটিতে চলে যায়। পরদিন মি. গাও’র কাজের বুয়া ফরিদা সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসায় আসেন। কিন্তু তিনি মি. গাওকে খুঁজে পান না। তবে রুমে গাও’র পরার স্যান্ডেলে দু‘ফোটা রক্ত দেখতে পায়। তখন বুয়া নিচে নেমে সিকিউরিটি গার্ডদের জানালে, তাদের পরামর্শে গাও’র ড্রাইভার, দোভাষী ম্যানেজার, তার বন্ধুসহ কারও মাধ্যমে তার খোঁজ পায় না। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ড্রাইভার সুলতান বিল্ডিংয়ের পেছনে মাটিচাপা অবস্থায় মি. গাও’র পায়ের গোড়ালি দেখে চিৎকার দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ এসে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।