দূরত্ব । গল্প । নাসরিন সুলতানা

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মোঃ ইসমাইল হোসেন,মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই ২০২১ : এই তো সেদিনের কথা। ভালোবাসার পরশ দিয়ে ডেকেছিলে আমায়। গভীর ভালোবাসা। মেঘকে ডেকে বৃষ্টির পানি যেমন করে নেয় মাটি? ঠিক সেইরকম অনুভব করি এখনো। সেই আষাঢ়ে দিন। কদমের মতো চোখ, মেঘের গর্জনের মতো চাহনী, ভূমিকম্পের মতো কম্পিত দুটো হাত। হয়তো সারাজীবন এমন করেই অনুভব করবো। অলির স্পর্শ অনুভব করে যেমন করে ফুল। সাঁতারুর দেহকে যেমন করে রাখে পুকুরের জল। ঠিক তেমন অনুভব করি।

জীবনের মানে বুঝা বড় কঠিন। কারো সমীকরণ কখনো মিলেনা। বীজগণিতের সরল অংকের মতো দূর থেকে দেখতে মনে হয় কতটা সহজ?  আসলে বাস্তবে ততটা নয়। সবাই জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে চায় কেউ হয়তো তা পারে না।আমিও পারিনি। কখনো মিথ্যে বলবো না পণ করেছি। চন্দ্র সূর্যের সকাল সন্ধ্যা আলো দেয়ার মতো সত্য। তবুও কেন বিশ্বাস করলেনা? কথা দিয়েছিলাম তাকে কখনো মিথ্যে বলবো না, বলিও নি কখনো। হয়তো ভবিষ্যতে এমনটা হওয়ার আগে যেন মৃত্যু আমায় নিয়ে নেয়। আমাদের প্রেম ছিলো ১৩ বছরের। হতে পারতো সেটা অনন্তকালের। অন্তিম কালের ডাক আসার আগ পর্যন্ত এক হয়ে থাকার পণ করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ অবিশ্বাসের গোলকধাঁধা এসে মাথায় ভর করলো।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাই।পাশাপাশি বাবা-মাকে কিছুটা খরচ দিতে হয়। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য বাসে চড়ে যাতায়াত করি। বাসে যাতায়াতের সময় একজনের সাথে পরিচয় হয়। তার নাম সজিব। কয়েক দিন একসাথে যাওয়ার পথে আলাপের পর খুব ভালো করে পরিচয় হয়ে যায় তার সাথে। পরিচয়ের পর একসময় দেখলাম আমার আত্মীয়। খালাতো ভাই। বয়সে অনেক বড়। সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তারপর প্রায় পচিশ বছর হলো আর দেখা নাই। আমাকেও আপন ছোট বোনের মতো স্নেহ করতে শুরু করলো।

আমি যেখানে পড়াশোনা করতাম উনিও সেখানের শিক্ষক ছিলেন। পড়াশুনায় সজিব ভাই নানাভাবে আমাকে সাহায্য করতেন। খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। সজিব ভাইয়ের সাথে এখন প্রতিদিনই বাসে করে একসাথে যাই। আলাদা সিটে বসে যাই প্রতিদিন। কিন্তু সেদিন কোন সিট খালি না থাকায় আমি নিজেই ওনাকে আমার পাশের সিটে বসতে বলেছিলাম।

হঠাৎ করেই সেইদিনই সোহাগ, আমার প্রিয় মানুষটা আসেন। তার কি কাজ আছে ভার্সিটি এলাকায় সেখানে যাবে। বাসে উঠেই আমাদের দিকে চোখ পরলো। প্রথমে বিষয়টাকে নিয়ে তেমন ভাবিনি। কিন্তু সোহাগের তাকানোটা যেন কেমন বিকট মনে হচ্ছে। বৈশাখ মাসের উত্তর দিকের আকাশে কালচে মেঘের মতো বিদঘুটে।১৩ বছর একসাথে আছি, তাছাড়া তার প্রতিটা শিরা উপশিরার চরিত্র আমার জানা হয়ে গেছে।মানুষটা খুব ভালো। ভীষণ ভালোবাসে আমায়। হয়তো সেই জন্যই অন্য একটা পুরুষের সাথে দেখে সে সইতে পারেনি। সেদিন থেকেই সোহাগ নিরুদ্দেশ। হঠাৎ করেই কোন খবর নাই। মোবাইলেও পাচ্ছি না।মেসেন্জার বন্ধ, ফেইসবুক বন্ধ, আত্মীয় পরিজনের কাছে খোঁজ নিয়েছি। কোথাও কোন খবর পেলাম না।

এমনি করে পাড়া প্রতিবেশি এমন কি তার দেশের বাড়ি টঙ্গীতেও খবর নিয়েছি। কিন্তু পেলাম না। আমিও মানসিকভাবে ভেঙে পরলাম। আমায় ভুল বুঝে সোহাগ এমনটা করতে পারলো? এত বছরের ভালোবাসা সব কি মিথ্যে ছিলো? কেমন ভালোবাসা ছিলো আমাদের? এক সিটে একজন পুরুষের পাশে দেখে আমায় সইতে পারলো না?

এমন নানা জটিলতায় সোহাগের প্রতি ঘৃনা চলে এলো। নিজের মন থেকে সোহাগের অস্তিত্ব আস্তে আস্তে দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করলো। মনে হলো অমাবস্যার অন্ধকার দেখছি চোখে। ভালোবাসা নামের সুন্দর ভরসা টার মধ্যে আলপিনের সামান্য খোঁচায় চির ধরে গেলো।

দিন দিন নিজেকে সম্পর্কের ভিতটা থেকে সরিয়ে নিলাম। কিন্তু নিজেকে আর কারো কাছে সপে দিতে পারিনি। পারিবারিক ভাবে অনেক সম্মন্ধ এসেছিলো। কিন্তু পারিনি ভালোবাসার সাথে নিজেকে আর জড়াতে। কারণ এর মধ্যে যে ঘুণ পোকা কড়াতের মতো কেটে দিয়েছে।

তবুও কেন তার কথাই মনে পড়ে? তবে কি এখনো সোহাগকে ভালোবাসি আমি? হয়তো এটাকেই গভীর ভালোবাসা বলে। বয়স তখন ৪০ বছর। আবার সেই বাসে উঠলাম তবে এখন পড়তে নয় পড়াতে যাই একটা বেসরকারি কলেজে। বাসে উঠে দেখলাম একজন ৪৫ বছরের লোক বসে আছেন বাসের সিটে। পাশের সিটটা খালি।সেখানেই বসে পড়লাম।

সেদিন বাসে বসে সেই দিনের স্মৃতি টুকু মনে পড়ছে। এই এক সিটে সজিব ভাইয়ের সাথে  বসেছি বলেই সোহাগকে হারালাম। আজ আবার ও এক সিটে একজন পুরুষের সাথে বসলাম। এখন সোহাগ দেখলে হয়তো আবার রাগ করতো। ভাবতে ভাবতে কলেজের কাছাকাছি চলে এলাম। নামতে গিয়ে ডান দিকে তাকাতেই দেখি সেই চেনা মুখ। ১৫ বছর পরে দেখলাম। চমকে গিয়েছিলাম বিদ্যুতের গতিতে। কালবৈশাখী ঝড় যেন গভীরে ছেদ করে দিলো । আমি যা দেখছি ঠিক দেখছি তো? স্বপ্ন নয় তো!

চিমটি কেটে দেখলাম না। সত্যি আমি দাঁড়িয়ে আছি বাসের এক লোহার রেলিং ধরে। সোহাগ সিটেই বসা এখনো। আমার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে। সেও বিশ্বাস করতে পারছে না এটা আমি কিনা!

কোন দিকে আর ভাবনার সময় বা ক্ষণ না দেখেই দুজনে দুজনার বুকের মাঝে লুটিয়ে পড়লাম।পাঁচ মিনিট মনে হলো আমি বেঁচে নেই। কোথায় হারিয়ে গেছি। সময়ের বিদঘুটে মেঘ যেন চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় এসে চোখে ঝাপটা দিয়ে ধরলো। হারিয়ে গেলাম অজানা কোন স্বপ্নের রাজ্যে।

হঠাৎ কন্ডাক্টর ডেকে উঠলেন। বাস থেকে নামুন। আপনার কলেজ গেইট চলে এসেছি।সোহাগকে নিয়ে নামতে গিয়ে দেখলাম তার হাতে লাঠি। এক পা নেই। হতভম্ব হয়ে গেলাম। বাস থেকে নেমে গেলাম দুজনে।
সোহাগ তোমার কি হয়েছে?
কোথায় ছিলে এতদিন?
কেন খবর নিলেনা?
তোমার পা কোথায় গেলো? এমন হাজারটা প্রশ্ন?

সোহাগ আমাকে এত বিচলিত দেখে নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। বাস স্ট্যান্ডের ছাউনিতে নিয়ে বসালাম। এতদিন তার সাথে যত রাগ অভিমান সব ভুলে গিয়ে সেই আগের ভালোবাসায় যেন আরো একশভাগ যোগ হয়ে একসাথে আবদ্ধ হয়ে মিশে গেলাম।সেও আমায় পেয়ে দিশেহারা। বাড়ি এলাম তাকে নিয়ে। তার হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা জানতে পেরে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে
করলো।

সেদিন বাস থেকে নেমেই ট্রেনের রাস্তা পার হতে গিয়ে তার এক পা ট্রেনে কাটা পরেছিলো।
বিষয়টা শুনে চিৎকার করে উঠলাম। ভূমিকম্পের মতো গহিনের সব ভেঙে চুড়মার হয়ে যাচ্ছে। এতদিনে তাকে ভুল বুঝে আমি অন্যায় করেছি।

বারবার তার কাছে ক্ষমা চেয়ে এতদিনের অবিশ্বাসের প্রয়শ্চিত্য করতে চাইলাম। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো- আরে পাগলী তোমায় ফিরে পেয়েছি এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। আর কিচ্ছু চাই না আমার। তোমার মতো পাগলীটা আমার বুকের মাঝে থাকলে আমার একপায়ে হাজার ভরসা পাবো।পাগলী ছাড়া পাগলের কিই বা মূল্য বলো?

নাসরিন সুলতানা : লেখক ও সংগঠক, সহ সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদ, সহ সভাপতি, মায়ের আঁচল সাহিত্য সামাজিক পরিষদ। ঢাকা, বাংলাদেশ।