নৃশংস ৪ হত্যার নেপথ্যে একই পরিবারের ‘অবৈধ সম্পর্ক’ ও ‘লোভ’!

SHARE

ছবির মাঝখানে মেহজাবিন মুন, উপর বাঁয়ে ছোট বোন জান্নাতুল মোহিনী, উপরে ডানে মা মৌসুমী ইসলাম, নিচে বাঁয়ে মুনের স্বামী শফিকুল এবং নিচে ডানে মুনের বাবা মাসুদ রানা।। ফাইল ছবি

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শনিবার, ২৬ জুন ২০২১ : ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’ এবং ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ -এই দুটি প্রবাদ বাক্যের বাস্তবতার সঙ্গে একটি পরিবার ভয়ঙ্করভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা যেনো পুরোপুরি মিলে গেলো। সম্প্রতি রাজধানীর কদমতলীতে মেহজাবিন মুন নামের এক নারীর হাতে তার বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম এবং ছোট বোন জান্নাতুল মোহিনী নৃশংসভাবে খুন হন। এই ট্রিপল মার্ডার এবং এর আগে একই পরিবারের হাতে গৃহশিক্ষক আমিনুলকে হত্যার কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।

অনুসন্ধান বলছে- রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর এলাকার লাল মিয়া সরকার রোডের ওই বাসায় একটি পরিবারে ‘অস্বাভাবিক ও অবাধ যৌনতা’ এবং ‘লোভ’ এই দু’টি কারণেই একই পরিবারের ৩ টি প্রাণসহ মোট ৪ জনের প্রাণ চিরতরে ঝরে গেলো!

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকগণ বলছেন, ‘অস্বাভাবিক ও অবাধ যৌনতা’ এবং ‘লোভ’ এগুলো খুবই ভয়ঙ্কর বিষয়। ‘বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক’ পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনকে কেবল বিষিয়ে তোলে না, গোটা পরিবারকে পুরোপুরি ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও একে অপরকে সময় না দেয়ায় পরিবারের মধুর বন্ধনে ভাঙন ধরে। পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কিংবা অন্য কোনও অনৈতিক সম্পর্ক যখন জানাজানি হয়ে যায়, তখনই ভুক্তভোগীদের মনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার ফলে ব্যক্তি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। অপরদিকে সন্তানদের ঠিকমতো গড়ে তুলতে না পারলে দিনদিন পারিবারিক অবক্ষয় ঘটতেই থাকবে। তাই ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে অবশ্যই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

‘অস্বাভাবিক-অবাধ যৌনতা’ ও ‘লোভে’ যেভাবে ধ্বংস হলো একটি পরিবার-

রাজধানীর কদমতলীতে ঘটে যাওয়া ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা অনুসন্ধানে নেমে বেরিয়ে আসে আরও একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সে অনুযায়ী ঘটনা সংশ্লিষ্টে হত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ জনে।

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি) চেষ্টা করেছে এসব হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত ও বিভিন্ন কারণ তুলে ধরতে, একইসঙ্গে এই ভয়ঙ্করতম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন একাধিক বিশ্লেষকগণ।

প্রবাসে ছিলেন পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য মুনের বাবা মাসুদ রানা, দ্বিতীয় বিয়ে সেখানেই

মাসুদ রানা ও মৌসুমী ইসলামের সংসারে দুই মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুন ও জান্নাতুল ইসলাম মোহিনী। তাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। সুখে শান্তিতেই তার দিন কাটছিলো। এক পর্যায়ের জীবিকার তাগিদে স্ত্রী ও স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়েকে দেশে রেখে মাসুদ বিদেশে পাড়ি জমান। ঘটনাক্রমে সেখানে তিনি এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেন। প্রথম দিকে দেশে প্রথম স্ত্রী ও দুই মেয়ের খরচাপাতি দিলেও দ্বিতীয় বিয়ের পর তা প্রায় বন্ধ করে দেন। পরিস্থিতিতে পুরুষশূণ্য একটি ফ্ল্যাটে স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়েকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান মৌসুমী। সংসারে টানাপোড়ন শুরু হয়।

এদিকে পরিবারটিতে কোনো পুরুষ সদস্য না থাকায় মৌসুমী ও তার স্কুল পড়ুয়া দু’টি মেয়ের দিকে কুদৃষ্টি দিতে শুরু করেন কেউ কেউ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সংসারের খরচ যোগানো ও জৈবিক চাহিদা কাছে হার মানেন মৌসুমি।

অসৎ উদ্দেশ্যে বারবার আহ্বান জানানো লোকদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন তিনি, এক পর্যায়ে নিজ বাসাতেই আসতে শুরু করে ওইসব লোকজন। সেই অনুযায়ী তার বাসায় বেশ কয়েকজন যৌনকর্মীরও অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। যা দেখে প্রথমদিকে স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেও পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মৌসুমী নিজেও বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে নিজ বাসাতেই সময় কাটানো শুরু করেন।

এক পর্যায়ে অধিক অর্থ উপার্জনের লোভে পড়ে নিজের বড় মেয়ে মেহজাবিন মুনকেও জোর পূর্বক দেহ ব্যবসায় সম্পৃক্ত করান এর কিছুদিন পর ছোট মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীকেও একই কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করান।

এদিকে দুই মেয়ে পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় তাদের স্কুলের পড়া বন্ধ করেননি মৌসুমী। ভালো পড়াশোনার স্বার্থে তাদের জন্য আমিনুল ইসলাম নামের এক গৃহশিক্ষককে ঠিক করেন। সেই গৃহশিক্ষক ওই ফ্ল্যাটে পড়াতে যাওয়া আসার এক পর্যায়ে সেখানে মা ও দুই মেয়ের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি টের পান। যে কারণে তিনিও ছাত্রী মেহজাবিনকে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে হবে মর্মে চাপ প্রয়োগ করেন, অন্যথায় সকলকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন। পরিস্থিতিতে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী মুন গৃহশিক্ষক আমিনুলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

এভাবেই ধীরে ধীরে একটি পরিবার ধ্বংসের পথে হাঁটতে থাকে। ঘটনার খুঁটিনাটি বিষয় এই প্রতিবেদনে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো-

মেধাবী ছাত্রী মুন ও জান্নাতিকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করান মা মৌসুমী

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পড়ালেখায় ভালো ছিলেন মুন। এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার মা আগেই দুই মেয়েকে অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে বাধ্য করেছেন। এমনকি পরীক্ষা চলাকালেও তাদের ছাড় দেওয়া হয়নি, বাসায় আসা পুরুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়েছে। এ কারণে এসএসসিতে জিপিএ ৪.৮ পান মুন। কৈশোরে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত করায় মেহজাবিন মুন মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। আবার তার বাবা মাসুদ রানা প্রবাসে আরেকটি বিয়ে করেছেন, দুই মেয়ের ব্যাপারে তিনি কোনো মনোযোগ দেননি। মায়ের নির্যাতন থেকে মেয়েদের বাঁচাতে কোনো ভূমিকা না রাখায় তার প্রতিও ক্ষোভ জমতে থাকে মুনের।

এদিকে মুনের স্বামী শফিকুল শ্যালিকা জান্নাতি মোহিনীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ায় সংসার ভাঙার উপক্রম হয়। যে কারণে ছোট বোনকেও দুনিয়া থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন বড় বোন মুন।

গৃহশিক্ষক আমিনুলের সঙ্গে মা ও ২ মেয়ের অনৈতিক সম্পর্ক

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বড় মেয়ে মেহজাবিন মুনের বিয়ের আগে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক মুনকে প্রাইভেট পড়াতেন। ওই সময় ছাত্রীর সঙ্গেও তার শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ওই গৃহশিক্ষক সুযোগ পেয়ে ছাত্রীর মা মৌসুমীর সঙ্গেও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দু’জনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ভিডিও করে রেখেছিলেন আমিনুল। সেটি হয়ে ওঠে তার হাতিয়ার। ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তিনি মা-মেয়েকে জিম্মি করে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি তিনি মুনের ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনী ও তার এক আত্মীয়ের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেন।

ছাত্রী মেহজাবিনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের ভিডিও স্বামীকে দেখানোয় পরিস্থিতি আরও জটিল

পরিবারে গৃহশিক্ষক আমিনুলের সঙ্গে মা ও দুই মেয়ের বহুমুখী জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের একপর্যায়ে মেহজাবিন মুনকে শফিকুল নামের এক জনের সঙ্গে বিয়ে দেন মা মৌসুমী। এতে ক্ষিপ্ত হন অবাধ যৌনতার সুবিধাভোগী গৃহশিক্ষক আমিনুল। তিনি ছাত্রী মেহজাবিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও তার স্বামীকে দেখান। এতে মুনের সংসারে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। পরিস্থিতিতে মা মৌসুমীও তখন আমিনুলের ওপর বিরক্ত হতে থাকেন।

অস্বাভাবিক যৌন জটিলতা নিরসনে গৃহশিক্ষক আমিনুলকে বাসায় ডেকে হত্যা

ছাত্রী মেহজাবিন মুন, ছাত্রীর মা মৌসুমী ইসলাম এবং ছাত্রীর ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর সঙ্গে আমিনুলের অবাধ যৌনতা এবং মোবাইলে ধারণ করা গোপন ভিডিও ধ্বংস করতে ছাত্রীর নতুন বিয়ে করা স্বামী শফিকুল, ছাত্রীর মা মৌসুমী এবং ছাত্রীর খালা শিউলী আক্তার পরিকল্পনা করে গৃহশিক্ষক আমিনুলকে বাসায় ডেকে নিয়ে গত ৫ বছর আগে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় মেহজাবিন মুনকে আসামি করা হলেও পরে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়নি ঢাকা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। যে কারনে শফিকুল, মৌসুমী এবং শিউলীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। যে মামলা তারা ৩ জন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

মুন ৯৯৯-এ কল দিয়ে জানান ‘বাবা-মা ও বোনকে খুন করেছি, আমাকে এসে ধরেন’

গত শনিবার (১৯ জুন) সকালে নিজেদের বাসা থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে ৩ জনকে হত্যার কথা জানান মেহজাবিন ইসলাম মুন। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে তার বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ও ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে। অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় মুনের স্বামী শফিকুল ও তাদের মেয়ে মারজান তাবাসসুম তৃপ্তিকে।

৬ মাসের পরিকল্পনায় যে কৌশলে বাবা-মা ও ছোট বোনকে হত্যা

মা-বাবা ও বোনের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন মেহজাবিন ইসলাম মুন। তাই ৬ মাস আগে ৩ জনকেই হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি-দুটি করে ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ শুরু করেন। শুক্রবার (১৮ জুন) দিনগত রাতে সেই ট্যাবলেট গুঁড়া করে চা, কফি ও পানিতে মিশিয়ে দেন। সেগুলো খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়লে শ্বাসরোধ করে ৩ জনকে হত্যা করা হয়।

তরমুজের জুসে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে প্রথম দফার হত্যা চেষ্টা ভেস্তে যায়

গত ২ মাস আগে প্রথম দফায় বাবা-মা ও বোনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন মেহজাবিন মুন। তখন তিনি তরমুজের জুসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মা এবং ছোট বোনকে খাওয়াতে পারলেও বাবাকে খাওয়াতে পারেননি। কারণ, ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় বাবা মাসুদ তরমুজের সেই জুস খেতে রাজি হননি। ফলে তার প্রথম পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

ওই সময়ে প্রশ্ন ওঠে- তরমুজ খাওয়ার পর মা-মেয়ে এত ঘুমাচ্ছে কেনো? তরমুজ সম্ভবত পঁচা ছিলো, তাই বিষক্রিয়া হয়েছে- তখন এমন ব্যাখ্যা দিয়ে প্রসঙ্গ কাটিয়ে দিয়েছিলেন মুন। সে ঘটনা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এত অল্প মাত্রার ওষুধে হবে না। হত্যা করতে হলে মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। এ কারণে তিনি গত শুক্রবার দুই মিলিগ্রাম মাত্রার ৪০টি ট্যাবলেটের গুঁড়া পানীয়তে মেশান। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, এই ঘুমের ওষুধ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ ৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেন, এর বেশি নয়।

হত্যায় মুন একা নন, স্বামী শফিকুলও ছিলেন!

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মুন একাই ৩ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তবে তার স্বজনরা বলছেন, অর্থ ও সম্পত্তির জন্য এ হত্যাকাণ্ড। এতে শফিকুলও জড়িত। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার স্বামীকেও প্রয়োজনে রিমান্ডে নেওয়া হবে।

পরে আজ সোমবার (২১ জুন) এ বিষয়ে কদমতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর বলেন, ‘গ্রেপ্তার মেহজাবিন ইসলাম মুনের স্বামী শফিকুলকে হাসপাতাল থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে আদালতেও হাজির করা হয়েছে।’

ওসি আরও বলেন, অনৈতিক সম্পর্কের জেরে ঘটে যাওয়া এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও কোনও কারণ লুকিয়ে আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় আর কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। পরিবারের অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে মামলাটির গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। স্বজনরা বলছেন, স্ত্রী মুনের পরিবারের সম্পদের প্রতি স্বামী শফিকুলের অনেক লোভ ছিলো।

গৃহশিক্ষক হত্যার মামলা নিষ্পত্তি জন্য টাকা ও সম্পত্তির লোভে শ্বাশুড়িকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা

মেহজাবিন ইসলাম মুন বাবা-মা ও বোনকে হত্যার দায় স্বীকার করলেও ঘটনাটি একা তার পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন স্বজনরা। মুনের খালা মোছা. ইয়াসমিন বলেন, গৃহশিক্ষক আমিনুলকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ২০ লাখ টাকা চেয়ে আসছিলেন শফিকুল। সেইসঙ্গে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তিনি বিভিন্নভাবে স্ত্রী ও শাশুড়িকে নির্যাতন করতেন।

জানা গেছে, ৪ বছর আগে একবার তিনি শাশুড়িকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান। সেবার প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর দগ্ধ হন শ্বাশুড়ী মৌসুমী। এ ঘটনা বাইরে প্রকাশ না করতেও চাপ দেওয়া হয়েছিল তাদের।

শ্যালিকা মোহিনীর সঙ্গে কয়েক বছর অবৈধ সম্পর্কে শফিকুল

স্ত্রী মেহজাবিন মুনের ছোট বোন অর্থাৎ শ্যালিকা জান্নাতুল মোহিনীর সঙ্গে নিজের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের একটি ভিডিও শফিকুল সংরক্ষণে রেখেছিলো। সেটি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে সে কয়েক বছর যাবত শ্যালিকার সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে আসছিলো। যখনই মোহিনীর বিয়ের প্রস্তাব আসত, তখন সে শ্যালিকাকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে বিয়ের উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দিতো।

স্বামী-স্ত্রীর যৌথ পরিকল্পনায় হত্যা!

অবাধ যৌনতার জেরে গৃহশিক্ষক আমিনুল হত্যা মামলা নিষ্পত্তির জন্য দাবিকৃত ২০ লাখ টাকা না পেয়ে শফিকুল এই হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে পুলিশের ধারণা ও স্বজনদের দাবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শফিকুল নিজ সন্তানকে হত্যার হুমকি দিয়ে স্ত্রী মুনকেও ট্রিপল হত্যাকাণ্ডে জড়িত হতে বাধ্য করান। মুন যে হত্যার দায় স্বীকার করছেন- এটি তার স্বামীরই পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে দাবি স্বজনদের।

এ বিষয়ে কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর আরটিভি নিউজকে বলেন, ভগ্নিপতি শফিকুলের সঙ্গে শ্যালিকার অবৈধ সম্পর্কের ভিডিওটির কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে এখনও সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা সেটি উদ্ধারের চেষ্টা করছি।

‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ ও ‘উগ্র ধাঁচের মোবাইল গেমে’ আসক্ত ছিলো মেহজাবিন মুন

ঘটনা অনুসন্ধানের জানা গেছে, ভারতীয় টেলিভিশন শো ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ এবং ‘উগ্র ধাঁচের মোবাইল গেমে’ আসক্ত ছিলেন মেহজাবিন মুন।

তার মুঠোফোন ঘেটে ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পুলিশ জানায়, মা, বাবা ও বোনকে হত্যায় গ্রেপ্তার মুন ভারতীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’- এর মনোযোগী দর্শক ছিলেন। অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। সেইসঙ্গে তিনি একটি মোবাইলে ‘উগ্র ধাঁচের’ অনলাইন ফোন গেমেও আসক্ত ছিলেন। অর্থের বিনিময়ে সেটি খেলতে হতো। সেই গেমে নায়ক বিভিন্ন কৌশলে শত্রুদের মেরে ফেলে। এছাড়া অচেতন করে হত্যার কৌশল সম্পর্কে জানতে অনলাইনে প্রচুর অনুসন্ধান চালিয়েছেন মুন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ দেখা, মোবাইল ‘গেম খেলা’ ও ‘অনলাইন অনুসন্ধানের’ মাধ্যমে পরিবারের ৩ সদস্যকে হত্যার কৌশল গ্রহণ করেন তিনি। এসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

রিমান্ডের প্রথম দিনই মেহজাবিন দিলেন চাঞ্চল্যকর তথ্য

বাবা-মা ও ছোট বোনকে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে গিয়ে মেহজাবিন মুন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। রিমান্ডের প্রথম দিনই তার কাছ থেকে গা শিউরে উঠার মতো অনেক তথ্য পাচ্ছে পুলিশ। এর আগে শনিবার (১৯ জুন) রাতে মুনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কদমতলী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন তার চাচা সাখাওয়াত হোসেন। ওই মামলার মুনের স্বামী শফিকুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। মামলা দায়ের পর গতকাল রোববার (২০ জুন) মুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ঘটনায় রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়া শফিকুলকেও এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ইতোমধ্যে তার রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।

কদমতলী থানার হত্যা মামলায় যা উল্লেখ করা হয়েছে

চাঞ্চল্যকর এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় মুন ও তার স্বামী শফিকুলকে আসামি করে কদমতলী থানায় দায়ের করা হত্যা মামলায় উল্লেখ করা হয়, বিয়ের পর থেকেই আসামিরা মৌসুমীর কাছ থেকে অর্থ দাবি করত। টাকা না পেলে নানাভাবে জ্বালাতন করত। সেইসঙ্গে তারা সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও চাপ দিয়ে আসছিল। এতে রাজি না হওয়ায় ৩ জনকে হত্যা করা হয়।

এই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত রোববার (২০ জুন) মুনকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

বিশ্লেষকগণের মতামত ও পরমর্শ

দেশে একের পর এক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর জিয়া রহমান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে কিছু কিছু পরিবারে আস্থার অভাব তো আছেই, তারপরও সম্পর্কগুলো যখন জনসম্মুখে চলে আসে তখন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। নিরাপত্তাহীনতা ও হিংসাত্মক মনোভাবের কারণেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের সম্পর্কগুলো যখন সমাজের সামনে চলে আসে তখন আরও অনেক মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মেখলা সরকার বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আগে ছিল না। তবে সম্প্রতি এটি প্রকাশ হচ্ছে বেশি। দাম্পত্য সম্পর্কে যখন কোনও সমস্যা হয়, তখন বিষয়টি জানাজানি হলে তা মানসিক চাপ বাড়ায়। অনেকেই তা সহ্য করতে পারেন না। তখনই ব্যক্তি হিতাহিত জ্ঞান হারায় ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। আবার ক্রাইম সিরিয়ালগুলোও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দেয়।’

একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আস্থার অভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে স্বামী বিভিন্ন সময়ে কাজের কারণে বাইরে থাকছে। স্ত্রী বাসায় একা। একাকীত্বের সুযোগে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার একইভাবে দেখা যাচ্ছে স্বামীরাও জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের দিকে। একটি পরিবার কিংবা দাম্পত্য পরিচালনা করতে যে মানসিক ও সামাজিক দক্ষতা উপলব্ধির প্রয়োজন, নিজেদের প্রস্তুত করার প্রয়োজন, ওই জায়গায় মোটা দাগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সমাজের এই বৃহৎ জটিলতা ও সমস্যা দূরীকরণে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারণা চালাতে হবে।