বাবার টিবি-মায়ের আলসার, হাল ধরেছে কুলসুমা (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),চাঁদপুর প্রতিনিধি,২২ জানুয়ারি : ‘বাবার টিবি রোগ হইছে, মায়ের আলসার। হেরা কেউই কাজকর্ম করতে পারে না। তাই বাধ্য হইয়া টোকাইয়ের কাম করি। সংসার চালাইতে ট্যাকা দরকার। ট্যাকা আয় করতে টোকাইয়ের কাম করি। এতে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই সংসার চলতাছে।’

কথাগুলো বলছিল কুলসুমা আক্তার (৯)। তারা ছয় ভাই-বোন। বাবা শহিদ ঢালী (৫৪) একসময় সবজি বেচতেন। ১০ বছর ধরে অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। প্রায়ই মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে। চিকিৎসক বলেছেন- তার টিবি হয়েছে। এছাড়াও আরও নানা রোগে ভুগছেন তিনি।

কুলসুমার মা কমলা বেগম (৪৫)। তিনিও অসুস্থ। আলসারসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। কাজকর্ম করতে পারেন না। পরিবারের ছোট তিন সন্তানই এখন সংসারের মূল নাবিক। তাদের কচি হাতে কঠিন সংসারের হাল ধরা। উপার্জনের মাধ্যমও খুব ঠুনকো। সারাদিন ধরে ভাঙ্গারি টুকিয়ে আর কতই বা উপার্জন হয়। তাতেই চলছে সংসার। বাবা-মায়ের টুকটাক চিকিৎসা।

ভাই-বোনের মধ্যে কুলসুমা সবার ছোট। তবে কাজে ছোট নয়। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। সারাদিন পরিত্যক্ত বোতল, প্লাস্টিকসহ নানা ভাঙারি টুকিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে।

এই কাজে সুখ না থাকলেও বিড়ম্বনার অভাব নেই। এই বয়সেই কুলসুমার কত যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ঠিক নেই। ‘টোকাই’ বলে ক্ষেপায় অনেকে। সারাদিন ধরে যে ভাঙ্গারি কুড়িয়েছে- সেসবও অনেকবার ছিনতাই হয়ে গেছে অন্য টোকাইয়ে হাতে। তবে তাতে দমে যায়নি কুলসুম। দীপ্ত প্রজ্ঞায় বাবা-মাকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলার প্রত্যয়ে দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে।

চাঁদপুর পৌর ৭নং ওয়ার্ডের উত্তর শ্রীরামদী খ্রিস্টান কবরস্থানের গলিতে কুলসুমার বসবাস। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সেখানেই থাকে সে। রেলওয়ের জায়গায় একটি ওয়ালসেট ঘরেই ওদের সবার থাকা এবং মালামাল রাখার ব্যবস্থা।

কুলসুমার মা কমলা বেগম বলেন, ‘আমার তিন ছেলে-তিন মেয়ে। এছাড়াও বিথী নামে আমার আরও একটি মেয়ে ছিল। সে হারিয়ে গেছে। বহু খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান মেলেনি। দীর্ঘদিন ধরে আলসারে ভুগছি। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। বুক জ্বলে, বমি হয়, কলিজায় রক্তক্ষরণ হয়। পেটের ভেতরে ব্যথা করে। ভালো চিকিৎসা করতে অনেক টাকার দরকার। সে টাকা আমাদের নেই।’

কুলসুমার বাবা শহীদ ঢালী বলেন, ‘আমি বাগদীর সন্তান। কমলা আমার জেঠাতো বোন। ভালোবেসে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করি আমরা। এখন ভাঙ্গারি কাজের ওপরই সংসার চলছে। প্রায় ১০ বছর হলো টিবি রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা করতে অনেক টাকার দরকার। এতো টাকা কোথায় পাব? প্রায়ই মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। হয়তো অন্য রোগও আছে। বাচ্চাদের কষ্টে নিজেরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব?’

কমলা আর শহীদ ঢালীর সংসারে বড় ছেলে সবুজ ঢালী (২২)। চৌধুরী ঘাটে ফলের ব্যবসা ছিলো তার। সে এখন ঢাকায় থাকে। ৩/৪ বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।

দুই বছর আগে মেয়ে বড় মেয়ে স্মৃতি আক্তারের (১৮) বিয়ে হয় হরিনা এলাকার সিরাজ বকাউল ও রহিমা বেগমের ছেলে মোবাইল মেকানিক রাসেলের সঙ্গে। তাদের দাম্পত্য জীবনে ইয়াছিন নামের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। কয়েকমাস আগে যৌতুকের দাবিতে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে রাসেল। সেও এখন বাবার বাড়ি।

কুলসুমার মেঝ ভাই বোরহান ঢালী (১৫) জানায়, বাবা-মা আগে সবজি বিক্রি করত। যে বাজারে তারা সবজি বিক্রি করত প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর বাবা-মা দুজনেই রোগে পড়ে গেলো। সে নিজেও শ্বাসকষ্টের রোগী। উপায়ান্তর না পেয়ে লেখা-পড়া ছেড়ে টোকাইয়ের কাজ বেছে নিতে হয়েছে তাকে।

ওই পরিবারের ছতুর্থ সন্তান ইসমাইল ঢালী (১৩)। সে জানায়, তার পড়ালেখার ইচ্ছা রয়েছে। বাবা-মাকে সুস্থ করে তোলার পর এবং সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরলে সে আবার স্কুলে যাবে। তবে তার সে স্বপ্ন পূরণ হবে কি না তা জানে না ইসমাইল। এছাড়া ছোট বোনেরা বড় হলে তাদের বিয়ে দিতে হবে। সেখানেও টাকা দরকার। এ চিন্তাও তার মাথায় রয়েছে। তাই সেও টোকাইয়ের কাজ করে।

পরিবারের পঞ্চম সন্তান খাদিজা আক্তার (১১) জানায়, আগে সেও টোকাইয়ের কাজে যেত। নিজেই ভ্যান চালিয়ে টোকাইকৃত মালামাল আনা-নেওয়া করত। এখন তার বয়স বেড়েছে। তাই মা-বাবা এখন তাকে বাইরে যেতে দেয় না। কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে! দিনকাল ভালো না। তাই বাসায় ঘরের কাজে মনোযোগী হয়েছে সে। অন্যদের কুড়িয়ে আনা মালামাল বাছাইয়ের কাজটিও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়েছে।

সবার ছোট কুলসুমা নিয়মিত ভ্যান চালিয়ে ভাঙ্গারি কুড়াতে যায়। তবে বোরহান ও ইসমাইল দুই ভাই দুটি ভ্যান নিয়ে গেলে তাকে বেশি কষ্ট করতে হয়। আরেকটি ভ্যান হলে তার জন্য ভালো হতো।

কুলসুমা বলে, ‘কাজ করলে পয়সা মিলব। বাবা-মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাইতে হইব। পড়ালেখা করলেতো আর পেটে ভাত যাইব না। তবে আগের মতো যদি বাবা-মারে সবজি ব্যবসায় বসাতে পারতাম! পরিবারের সব অভাব অনটন দূর করতে পারতাম! তাইলে পড়ালেখা করে জীবন আরও বহুদূর আগাইয়া যাইতাম।’

শহরের চাকচিক্যময় আলোর নিচে এমন কত অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে, তার খোঁজ কেই বা রাখে? তারপরও এখনও এমন অনেক সহৃদয়বান ব্যক্তি আছেন, যাদের সামান্য অঙ্গুলি হেলনে কুলসুমাদের মতো মানুষগুলোর জীবন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে নির্ভাবনাময়। সংসারের কঠিন যাঁতাকল নয়, স্বপ্নময় ফুলেল ভূবনই হয়ে উঠবে তাদের ঠিকানা।