জীবনের চেয়ে বড় কোনো ঈদ, পূজা নাই

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,২৫ মে : এমন ঈদ কি আমাদের কল্পনায়ও এসেছিলো কোনো দিন? ঈদে বাড়ি বাড়ি যাবো না, সেমাই-চটপটি-পায়েস খাবো না, সালাম করবো না কাউকে, কোলাকুলি করবো না কারো সঙ্গে… এমন ঈদ কোনো দিন আমাদের দুঃস্বপ্নেও ছিলো না। বাস্তব কল্পনার চেয়ে রূঢ়, দুঃস্বপ্নের চেয়েও কঠিন।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লিডসে অবস্থিত মক্কা মসজিদের ইমাম এবং জাতীয় মসজিদ ও ইমাম উপদেষ্টা বোর্ডের প্রধান ক্বারী মুহাম্মদ আসিম বলেছেন, ‘ছয় মাস আগেও এমন ঘটনা কল্পনা করা যায়নি, কিন্তু আজ অকল্পনীয় ব্যাপারগুলোই সত্যি হয়ে উঠেছে!’

কল্পনাকে অস্বীকার করা যায়। দুঃস্বপ্নকে ভুলে থাকা যায়। কিন্তু রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হতেই হয়। আপনি আমি চাই বা না-চাই, যে বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী হচ্ছে তার অংশীদার হতেই হবে। হয়তো এই নিঠুর করোনাকালে আমরা হারিয়েছি প্রিয়জনকে, হয়তো হারিয়েছি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। কিন্তু এই কি সব? আমরা কি কেবল হাত-পা গুটিয়ে ক্রন্দনে ডুবে যাবো?

বাস্তবতা যতো কঠিনই হোক, মানুষ তার চেয়েও কঠিন। গুহাযুগ পার হয়ে মানুষ এতো দূর এসেছে টিকে থাকার লড়াইয়ে জয়ী হয়ে। সেই যে পাপা হেমিংওয়র কথা, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজয় মানে না।’ কোনো প্রবল পরিস্থিতির মুখেই মানুষ পরাজিত হবে না। মানব সভ্যতা টিকে থাকবে লড়াই করেই। আদতে লড়াইয়ের ইতিহাসই টিকে থাকার ইতিহাস। আর টিকতে হলে, জয়ী হতে হলে, মানুষকে হতে হবে কৌশলী।

ভাইরাস নিজে বড় কৌশলী সত্তা। সে ঘাপটি মেরে থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে ঝিম মেরে থাকে। সুযোগ পেলেই মাথা চাড়া দেয়। এই ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে আমাদেরকেও কৌশলী হতে হবে। হাত ধোয়া, ঘরে থাকা, মাস্ক পরা- এ সব বাহ্যিক কৌশল তো আছেই, এর সঙ্গে যার যা আছে তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার মতো করেই নিজস্ব কৌশলও বেছে নিতে হবে। মোদ্দা কথায়, শারীরিক বা মানসিকভাবে পরাজয় মানা যাবে না। মনে রাখতে হবে,  স্প্যানিশ ফ্লু, বিবোনিক প্লেগ, যক্ষা, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়ার মতো মহামারি পার করে আমরা টিকে থেকেছি। এই করোনার বিরুদ্ধে টিকে থাকবো। নিজের শারীরিক সক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো এই দীর্ঘ লকডাউনে আয়ত্ব করতে হবে। এতো দিন আমাদের বুঝে যাওয়ার কথা অর্থ, বিত্ত, খ্যাতির চেয়ে স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক খাতের চেয়ে স্বাস্থ্য খাত বেশি মজবুত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের নিজেকে মজবুত করাও জরুরি।

রিলে রেসের ব্যাপারটি খেয়াল করুন। কয়েকজন মিলে এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হয়েই একজন তার হাতের কাঠি অন্যের হাতে দেয়। এভাবে হাত থেকে হাতে কাঠি বদল হয়ে এগুতে থাকে দৌড়। মানব জাতি, মানব সভ্যতা এই রিলে রেসের মতোই। আমি খানিকটা দৌড়াই, তারপর আরেকজনকে দায়িত্ব দেই, আমি দৌড়ে পিছিয়ে গেলে পরের জন বেশি জোরে দৌড়ে এগিয়ে নেয়। এই সম্মিলিত প্রয়াসটা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি জীবনের ১০০ মিটারের দৌড়টা একা দৌড়ানো যায়। কিন্তু হাজার মিটারের দীর্ঘ দৌড় সম্মিলিতভাবে দৌড়াতে হয়। যার যার দৌড়টুকু ঠিকঠাক দৌড়ালেই আমরা সম্মিলিতভাবে জিতে যাবো। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করুন, আমি আমার, ব্যস এটুকু করলেই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর্মী তার সাধ্যমতো চিকিৎসা দিক, সাংবাদিক সঠিক খবরটি দিক, নেতা ও শিক্ষক পথ নির্দেশনা দিক, মোল্লা-পুরোহিত সু-পরামর্শ দিক, নিরাপত্তাকর্মী নিরাপত্তা দিক… এভাবে প্রত্যেকে আমরা সকলের তরে কাজ করতে পারি কেবল নিজের কাজটুকু করলেই।

আরেকটি সুকৌশলের কথা বলি। বেশি বাহাদুরী দেখাবেন না। বন্দুকের সামনে অহেতুক বুক পেতে দিলেই বীর হওয়া যায় না, বরং লোকে বেকুবই বলবে। আমার কিচ্ছু হবে না ভেবে অহেতুক ঘোরাঘুরি করবেন না। সৌভাগ্যক্রমে আপনার কিছু নাও যদি হয়, আপনার মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি হতে পারে। অন্যের ক্ষতি করা, অহেতুক বাহাদুরী করা থেকে বিরত থাকুন। নিজেকে এবং অন্যকে সুরক্ষার কৌশল আয়ত্ব করুন। নইলে করুণ পরিণতির জন্য তৈরি থাকুন।

এটা ঠিক, এমন ঈদ আর কখনোই আসেনি। ঘরে বসে ঈদ উদযাপন অতোটা মনোরম মনে না হতে পারে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার চেয়া পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই ভালো। এই ঈদ বরং ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দিতে পারে। একান্তই ঘরের মানুষের সঙ্গে পালন করা যাক একটা ঈদ। মা হয়তো প্রতি বছর পায়েস, সেমাই করে, বোন হয়তো চটপটি, কাবাব করে, বউ হয়তো পোলাও, মাংস করে, আপনি এবার না হয় তাদের জন্য কিছু একটা করুন। মায়ের হাতে আপনার রান্না করা কিছু তুলে দিন। বাবা কিংবা ভাইয়ের জন্য একটা রুমাল অন্তত বানাতে পারেন ঘরে বসেই। পরিবারের সবাই মিলে ঈদের দিন কোনো প্রিয় সিনেমা দেখুন, একে অপরকে গান গেয়ে শোনান, কবিতা পড়ে শোনান, ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করুন। নিজেদের লেখা গল্প, কবিতা দিয়ে হাতে লেখা ঈদসংখ্যা করুন, বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাদের সাজশয্যার দায়িত্ব দিন। অনলাইনে পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ অনুষ্ঠান করুন। একসাথে ভার্চুয়াল কলের মাধ্যমে ঈদের কোলাকুলি, খাওয়া দাওয়াও করা যেতে পারে। বিকাশে সালামি দিতে পারেন, বারান্দা বা ছাদ থেকে প্রতিবেশীকে ঈদ মোবারক জানানো যাবে। বাড়ির সবাই মিলে ঈদ করুন।

কিন্তু মোদ্দা কথা,  মন খারাপ করা যাবে না। চাঙ্গা থাকতে হবে। মন ঠিক থাকলে শরীর সহজে বিগড়ে যাবে না। মনে রাখবেন, বেঁচে থাকলে ঈদ, পূজা আরো আসবে। সবাই মিলে সেমাই, নাড়ু খাওয়া যাবে। খুব কোলাকুলি, আলিঙ্গন, উল্লাস হবে। কিন্তু বেঁচে থাকাটা ফরজ। আপাতত ফরজে মনোযোগ দিন। বাঁচলেই কেবল আবার ঘুরে বেড়াতে পারবেন, আনন্দ-উল্লাস করতে পারবেন। কিন্তু বাঁচতে হবে। সুকৌশলে এই ভাইরাসকে এড়িয়ে যেতে হবে। যখন লড়াই করার মতো অস্ত্র পেয়ে যাবো তখন না হয় ময়দানে নেমে এক হাত দেখে নেবো করোনাভাইরাসকে। এখন বরং ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার কাল। যুদ্ধের সময় মানুষ গর্ত করে লুকিয়ে থাকে না? তাহলে এখনও একটু ধৈর্য ধরে সামলে চলুন। জীবনের চেয়ে বড় কোনো ঈদ, পূজা নাই। জীবিত মানুষের জন্যই আনন্দ উৎসব। জীবিত থাকুন।