ছবিটি জাতির জন্য লজ্জার!

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি,৩০ মার্চ : গত ২৭ মার্চ যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) সাইয়েমা হাসান করোনা প্রতিরোধে মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধ ভ্যানচালককে কান ধরে উঠবোস করানোর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা না মানায় তাঁদের কান ধরিয়ে দাঁড় করে সেই ছবি নিজ মোবাইল ফোনে ধারণের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। খেটে খাওয়া মানুষদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা এটি নতুন নয়। কাজেই এ বিষয়ে আমি খুব বেশি অবাক হইনি। কারণ বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের হত্যা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন এক ধরনের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সেগুলোর অনেক কিছুতেই আমরা প্রতিবাদ করি। আবার অনেক কিছুই আমরা জানতে পারি না বিধায় প্রতিবাদের মোটেই সুযোগ হয় না। আমাদের সমাজে এমন অনেক নির্মম ঘটনা ঘটে, যেগুলো আমরা জানতে পারি না। অনেক সময় জানতে পারলেও যথাযথ প্রমাণের অভাবে প্রতিবাদ হয় না। আবার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাল্টা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।

আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করেন, অনেকে ক্ষমতার দাপটও দেখান। তাঁরা সব সময় চান আলাদা গুরুত্ব, আলাদা মর্যাদা, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা। এই বাড়তি মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে তাঁদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলেন। অথচ তাঁদের সেটি করার কথা নয়। জনসেবা, জনকল্যাণ, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করাই যাঁদের একমাত্র কাজ হওয়ার কথা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা রাষ্ট্রের এসব স্থায়ী কর্মচারীকে ইংরেজিতে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনগণের চাকর। তাঁদের একমাত্র কাজ জনগণের সেবা করা। কারণ তাঁদের বেতন-ভাতা হয় সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। রাজনীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞার আলোকে উপস্থাপিত ‘আদর্শ আমলা’র সন্ধান বড় বেশি পাই না। আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখি, আমলা হচ্ছেন সরকারি চাকরি করা বড় বড় পদবিধারী ক্ষমতাধর মানুষ, যাঁদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে যেতে পারে না।

আমলাদের সম্পর্কে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ।’ তিনি আরো বলেছিলেন, আমলারা সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বের পূজারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এই আমলাসমাজ। লেনিনও আমলাদের সম্পর্কে একই রকম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন।

আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে অতীতের ধারাবাহিকতায় জনগণের ওপর না হয়ে আমলাতন্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশে এখন সরকারের টিকে থাকার পেছনে জনগণ নয়, আমলাদের ভূমিকাই প্রধান। তাই সর্বত্র আমলাতন্ত্রের জয়জয়কার। এই আমলাদের পরামর্শে ও সাহায্যে কিছু সরকারি দলের রাজনীতিবিদ গণবিরোধী কুকর্মগুলো করেন বলে আমলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এসব সরকারি কর্মকর্তার পেছনের শক্তি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তাদের যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে থাকেন। সংগত কারণেই সাধারণ জনগণকে এসব কর্মকর্তা তোয়াক্কা করেন না কিংবা আমলে নেন না। যেসব খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের টাকায় তাঁরা বেতন পান, তাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতে কোনো রকম কুণ্ঠা বোধ করেন না।

একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা কয়েকজন ভ্যানচালককে কান ধরে উঠবোস করানোর ছবিটি পেছন থেকে কেউ একজন না তুললে কোনোভাবেই আমরা এটি জানতে পারতাম না। সে ক্ষেত্রে ছবিটি ওই কর্মকর্তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়ই থেকে যেত। কোনোভাবেই এটি ভাইরাল হতো না। ওই কর্মকর্তা বীরের মতো তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন মর্মে—নিজেই সেটি বিবেচনা করতেন। বাংলাদেশে তথাকথিত আমলা নামধারী অনেক সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা নিজেদের এমন বীর ভাবতে থাকেন। তাঁরা কোনো অন্যায় করলেও সেটি বৈধ হয়ে যায় প্রতিবাদের অভাবে। আর সে কারণেই দেশে নানা অন্যায়-অপকর্ম সংঘটিত হতে থাকে একের পর এক।

চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক ও তাঁর অধীন কর্মচারীরা মধ্যরাতে একজন সাংবাদিককে বেধড়ক পেটানো ও জেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হয়। পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে প্রশাসন। দুই সপ্তাহের মাথায় আবারও প্রশাসনের একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে নিগ্রহের অভিযোগ উঠল।

করোনাভাইরাস রোধে চলাচল সীমিত রাখার সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাস্তায় কাউকে পেলে কান ধরে উঠবোস করানো, লাঠিপেটা করা, মাটিতে গড়াতে বাধ্য করার মতো বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে লজ্জার এবং শঙ্কার। এটি শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্যই লজ্জার নয়, গোটা জাতির লজ্জার বিষয়। এ ঘটনায় অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এরই মধ্যে ওই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর হয়তো বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হবে। কিন্তু এসব নেতিবাচক কার্যক্রমের সমাপ্তি কি ঘটবে? কোনোভাবেই কি এসবের চূড়ান্ত সমাধান সম্ভব নয়?

ক্রমাগত সাধারণ মানুষের লাঞ্ছনার ঘটনায় গোটা দেশের সার্বিক পরিবেশ ক্রমেই বিনষ্ট হচ্ছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্র্রতিক সময়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কিন্তু এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেই। রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে এবং পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িতে যখন গোটা জাতি মেতে উঠেছে, ঠিক সে সময় প্রায়ই সাধারণরা লাঞ্ছিত হয় নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে। কঠোরভাবে এমন প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com