বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ৬ খুনিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ষ্টাফ রিপোর্টার,১৮ মার্চ : বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ৩৪ বছর পর ২০১০ সালে ১২ খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত। তাদের ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলেও বাকি ৭ জনের মধ্যে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে আজিজ পাশার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।

ফলে ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের কোনো চেষ্টাই কাজে আসছে না। ঘাতকরা দণ্ড মাথায় নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে খুনিরা যেসব দেশে লুকিয়ে আছে সেসব দেশের সঙ্গে আলোচনাকে অগ্রগতি হিসেবে দেখছে বর্তমান সরকার।

বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বিশেষ টাস্কফোর্সের প্রধান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা অব্যাহত আছে। খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মগ্রহণের শততম বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বছরব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে পরবর্তী সরকার। শুধু তাই নয়, খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেয়া এবং তৎকালীন সামরিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনিরা রাজনৈতিক দল পর্যন্ত গঠন করে। কোনো কোনো খুনিকে এমপিও করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে করা ইমডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। শুরু হয় খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া।

ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি : বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।

ওই বছর ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়।

দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে বিচার : ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন।

কিন্তু অপর বিচারক এবিএম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিমকোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন।

২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৭ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। এরা হলেন বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ।

৬ খুনি এখনও পলাতক : জাতির পিতার খুনিদের মধ্যে পলাতক ছয়জনকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কে কোন দেশে পালিয়ে রয়েছেন, সে সংক্রান্ত সব তথ্য এখনও জোগাড় করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এই ৬ জন হলেন খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান।

পলাতক এই ছয়জনের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এই নোটিশ জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে। এই ছয়জনের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নূর চৌধুরীর কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের অবস্থান কোথায়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। নূর চৌধুরী কানাডায় থাকলেও ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখিয়ে আসছে দেশটির সরকার। যদিও তাকে ফেরত পেতে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। রাশেদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ তাকে ফেরত চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র তা এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।

মাজেদ ও মোসলেম উদ্দিনের ব্যাপারে এনসিবি সূত্র জানায়, সর্বশেষ এই দুজনের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে বলে শোনা যাচ্ছিল। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেয়া হয়। ভারত জবাবে বলেছে, তাদের দেশে নেই। পাকিস্তান কোনো জবাব না দেয়ায় রিমাইন্ডার দেয়ার পরও কোনো উত্তর মেলেনি। ফলে তাদের অবস্থান এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। রশিদ ও ডালিমের অবস্থানের বিষয়েও স্পষ্ট তথ্য নেই।

সূত্র আরও জানায়, রশিদের ব্যাপারে সম্ভাব্য যে সব দেশের নাম শোনা যাচ্ছে তা হচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি, লিবিয়া, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। আর ডালিম চীন, ইংল্যান্ড, হংকং, কেনিয়া, লিবিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে কোনো এক দেশে আছে। প্রতিটি দেশে চিঠি পাঠিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হলেও তার কোনো জবাব এখনও মেলেনি।