ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ষ্টাফ রিপোর্টার,০১ মার্চ : যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া মাদক, নারী ও ক্যাসিনো ব্যবসাসহ নানা রকম অবৈধ ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এর মধ্যে ব্যাংককসহ চারটি দেশে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ২০১৫ সালের দিকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে পাপিয়া খরচ করেছিলেন তিন কোটি টাকা। এছাড়া উপঢৌকন হিসেবে প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে দিয়েছিলেন বিশেষ উপহার। তাদের নির্দেশেই ওই সময় পাপিয়া যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করছেন পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীসহ অন্যান্যরা। গোয়েন্দা পুলিশ পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কখনো এককভাবে আবার কখনো দু’জনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের দুই সহযোগী সাব্বির ও তায়্যিবাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া জানিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করতেন তিনি। তবে কাউকে জোর করে কিছু করাননি বলে দাবি করেছেন। তার সঙ্গে কাজ করার কারণে তরুণীদের নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। তার খদ্দেরদের তালিকায় রয়েছেন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিরা। যাদের নাম জানার পর তদন্ত সংশ্লিষ্টরাই হতভম্ব।
রিমান্ডে নিজের বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কে পাপিয়া জানিয়েছেন, নারীদের আকর্ষণ কার নেই। এখন সব দোষ পাপিয়ার হবে কেন। এসময় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কয়েক প্রভাবশালী নেতা ও ব্যবসায়ীদের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। ওই সূত্র জানায়, অন্যান্য গুরুতর অপরাধ সম্পর্কে প্রায় প্রশ্নেই নীরব থাকছেন পাপিয়া। কখনও কখনও কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। ওয়েস্টিন হোটেলে বসে চাকরি-বদলি, টেন্ডারের তদবির, অবৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন পাপিয়া। এসব বাণিজ্যের মধ্যে ছিল অস্ত্র ও মাদক। জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। পাপিয়া জানিয়েছেন, সরকারি দলের নেত্রী হওয়ার কারণে তার কথার বাইরে যেতো না প্রশাসন। এরমধ্যে নরসিংদীতে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর নির্দেশের পর প্রশাসন তাকে সবসময় সহযোগিতা করত।
গোয়েন্দা সূত্রে জানান গেছে, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া স্বীকার করেছেন যে, পাপিয়া নিজস্ব ক্যাডারবাহিনী কিউ অ্যান্ড সি’র সদস্যদের দিয়ে মাফিয়া প্রধান হয়ে যান। কিউ অ্যান্ড সি’র সদস্যরা মাদক ব্যবসা, চাঁদা তোলা, মাসোহারা আদায়, তুলে এনে টাকা আদায়, অনৈতিক কাজ করানো এবং জমি দখলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাপিয়ার হাতে তুলে দিতেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও প্লট কেনেন। এ ছাড়া পাঁচতারকা হোটেলে বসে মাস্তি করতেন। সেখানেও কম বয়সী তরুণীদের জোর করে ধরে এনে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তরুণীদের গোপন মেলামেশার ছবি তুলে ও ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতেন পাপিয়া। এভাবে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন পাপিয়া-সুমন দম্পতি।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেতা শামিমা নূর পাপিয়ার অনৈতিক কর্মকান্ডে দল বিব্রত। শুধু পাপিয়া নয়, দুষ্কৃতকারীদের গডফাদারদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
অন্যদিকে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেত্রী পাপিয়াকে রিমান্ডে এনে কী জানতে চাওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জাবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে আমরা তা তদন্ত করছি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা এবং ক্রিমিনাল অপরাধ সেগুলো চিহ্নিত করছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে পাপিয়া জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী লীগ, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি এবং সভাপতিমন্ডলীর বেশ কয়েকজন নেতাকে পাপিয়া অন্তত ১০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। বিনিময়ে চেয়েছিলেন নরসিংদী থেকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন। সেটি না হওয়ায় ওই বিনিয়োগটি বিফলে যায়। প্রচন্ডভাবে মানসিক বিষন্নতায় পড়েন পাপিয়া। শুরু হয় তার আগের চেয়ে বেপরোয়া জীবন-যাপন। এভাবেই একসময় তিনি অপরাধ জগতের সম্রাজ্ঞী বনে যান। একের পর এক অপরাধ কর্মে লিপ্ত হতে শুরু করেন। আর তাকে এসব কাজে সহযোগিতা করেন স্বামী সুমন চৌধুরী ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা।
পাপিয়া ও সুমন চৌধুরীর অপরাধ জগত সম্পর্কে তায়্যিবা পুলিশকে জানিয়েছে, অনেক সময় চাহিদা মতো থাই, নেপালি, ইন্ডিয়ান, ভুটানি ও রাশিয়ান মেয়েদের নিয়ে আসা হতো। তাদের উচ্চমূল্যে বিভিন্ন কাস্টমারের কাছে পাঠানো হতো। এছাড়া বিমানবন্দরে কোনো ঝামেলা হলে সুমন চৌধুরী ও পাপিয়া মেটাতেন। পার্বত্য অঞ্চল থেকেও পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে আসতেন পাপিয়া।
একটি সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কমকে বলেন, এখন পর্যন্ত পাপিয়ার অন্ধকার জগতের বেশকিছু তথ্য মিলেছে। সেগুলোর আরও যাচাই-বাছাই চলছে। অর্থের উৎসের খোঁজ খানিকটা তথ্য মিলেছে। তবে এর পেছনে আর কেউ জড়িত কি না তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।
পাপিয়ায় বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, পাপিয়াসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে তারা। সেসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। অর্থপাচারের মামলাটি সিআইডি দেখবে। তবে তাদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অর্থপাচারের বেশকিছু তথ্য মিলেছে। অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের তথ্যও মিলেছে। রিমান্ডের আরও সময় বাকি আছে। আশা করছি, এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।
উল্লেখ্য, গত ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থপাচার, বিদেশি জাল মুদ্রা সংরক্ষণ ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে র্যাব-১ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে পাপিয়া, তার স্বামী ও দুই সহযোগীকে। পরে তাদের নিয়ে ফার্মগেটের বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, বিদেশি মুদ্রা ও পিস্তল, গুলি ও মদ উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি এবং শেরেবাংলা নগর থানায় দুটি মামলা করে র্যাব। তিন মামলায় পাপিয়াসহ চারজন ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। মামলাটি এখন ডিবিতে রয়েছে। এছাড়া পাপিয়াসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে র্যাব।
পাপিয়ার কাছে কারা যেতেন ওয়েস্টিনে
শামিমা নূর পাপিয়া ওয়েস্টিন হোটেলে অবস্থানকালে কারা কারা তার কাছে যেতেন, তাদের নাম হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, হোটেলে অবস্থানের সময় পাপিয়া কার কার সাথে দেখা করেছেন বা তার কাছে কারা কারা আসতেন, সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিসি ফুটেজসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। একইসাথে এই হোটেলে তিনি কীভাবে বিল দিতেন, তার ক্যাশ মেমো চাওয়া হয়েছে।