মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অমার্জনীয় অপরাধে মন্ত্রীর কেন পদত্যাগ নয়?

SHARE

পীর হাবিবুর রহমান,লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের বীর ও তাদের পরিবার-স্বজনদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে তুমুল প্রতিবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তার প্রকাশিত বিতর্কিত রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যাচাই-বাছাই না করে এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা তালিকা প্রকাশের জন্য অসন্তোষ ব্যক্ত করে স্থগিতের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর মন্ত্রী এটি স্থগিত করে বলেন, যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রকাশিত রাজাকার তালিকায় দেশের চিহ্নিত ও দন্ডিত যুদ্ধাপরাধী থেকে শুরু করে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর সদস্য এবং আলবদর, আলশামস, আল মুজাহিদ বাহিনীসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের নাম প্রকাশ না হলেও মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক, যোদ্ধা এমনকি শহীদের স্ত্রীকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর দায় চাপিয়ে দিতে চাইলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেটি যেমন মানতে চাননি, তেমনি দেশের কোনো মহলই এ বক্তব্য গ্রহণ করেনি। এমনকি স্থগিতের আগে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর যোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য অতীতের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। তার এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। টানা ১১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের চারজন সচিব মুক্তিযোদ্ধা হতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধ না করেও কেউ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঢুকে গেলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একজন স্বাধীনতাবিরোধীকে যেমন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর যোদ্ধা ও শহীদজায়ার নাম রাজাকার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি মুুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়।

রাজাকারের বিতর্কিত এ তালিকা নিয়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, এর মধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে এ প্রকল্পে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কথায় পেনড্রাইভে করে যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ তালিকা এসে থাকে, আর সেটাই যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলে এত টাকা গেল কোথায়? কাদের পকেটে ঢুকেছে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ। ভয়ঙ্কর এই দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করতে হবে।

জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে যেমন আমরা ব্যর্থ হয়েছি, তেমনি এই যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বিশ্বাসঘাতক হানাদার বাহিনীর দোসর স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের তালিকায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা প্রকাশ অমার্জনীয় অপরাধ। এর মাধ্যমে সব বীর ও শহীদকে অপমান করার দায় ক্ষমা, দুঃখ প্রকাশ ও স্থগিতে শেষ হয়ে যায় না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে ও তার মন্ত্রণালয়ের যারা যাচাই-বাছাই ছাড়া এ ধরনের বিতর্কিত ও ষড়যন্ত্রমূলক তালিকা প্রকাশ করেছেন তা সহজ-সরলভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যুগের পর যুগ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। গোটা সমাজ দুর্নীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকের মতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিছু মন্ত্রণালয় দুর্নীতির কলুষিত ভয়াবহ চিত্র নিয়ে জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আমরা কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগ চাইনি। দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে চেয়েছি। আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস দেখছি, তবু বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ আশা করিনি। কিন্তু বছরের পর বছর যে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছে, সেখানে এই তালিকায় যখন মুক্তিযুদ্ধের বীরদের নাম যুক্ত করে বিতর্কিত তালিকা দেওয়া হয়, তখন শুধু মন্ত্রীর পদত্যাগ নয়, এই অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা ঐতিহাসিক সময়ের দাবি। যদি পদত্যাগ না করেন তাহলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে সবিনয় নিবেদন, এমন দায়িত্বহীন ব্যর্থ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করুন। একের পর এক দু-চারজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ধারায় দায়িত্বহীন উদাসীনতা ও অদক্ষতার নজির সৃষ্টি হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মন্ত্রী করেছেন, তাঁর আশা পূরণ করার জন্য। জনগণকে সুখী রাখার জন্য। মানুষের দুর্ভোগ বাড়াতে নয়। তেমনি জনগণের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য নয়। বিকৃত ইতিহাসকে সত্যের আলোয় ফিরিয়ে আনার জন্য। অতীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ও সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে। কিন্তু কারও সাহস হয়নি, একজন মুক্তিযুদ্ধের বীরকে রাজাকার বলে জাতির সামনে অপমান করার। এমন নজিরবিহীন বেদনাদায়ক ঘটনা এবার ঘটিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও তার মন্ত্রী। মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা না গেলে এ ধরনের দায়িত্বহীন উদাসীনতা ও ক্ষমতার ব্যর্থতা ক্রমে বাড়বে।

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে রাজাকারদের তালিকা যদি প্রকাশ হয়, সেটি যাতে নির্ভুল হয় সেজন্য একজন মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক ও যোদ্ধা যিনি দক্ষতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সত্য উন্মোচিত করতে পারেন তাকেই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এই বেদনাদায়ক ঘটনা সেই শিক্ষাই আমাদের দিয়েছে। এ তালিকা প্রণয়নের জন্য যোগ্যদের নিয়ে যেমন কমিটি গঠন দরকার তেমনি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের শক্তিশালী আরেকটি কমিটি দরকার। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে শান্তি কমিটির অনেক সদস্য ছিলেন, যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজের প্রভাবশালী মুখ এবং অনেকের সন্তানরা আজ সরকারের মন্ত্রী থেকে নানা পর্যায়ে রয়েছেন। বছরের পর বছর তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পিতার দায় সন্তান নেবে এমনটি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারাই যখন বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানদের আওয়ামী লীগে ঠাঁই নেই। সেখানে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন পরিষদের কমিটিতেও দেশসেরা রাজাকারের সন্তান ঠাঁই পান। মুক্তিযুদ্ধের পর পাওয়া শান্তি কমিটির সদস্য, জেল খাটা রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের নাম যেমন সরকারের কাছে থাকার কথা, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রয়েছে তেমনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের লেখা অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাসনির্ভর বই এমনকি অনেক জাতীয় দৈনিকের ধারাবাহিক প্রকাশিত সিরিজে তাদের তালিকা রয়েছে। এ ছাড়া দেশে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশহগ্রহণকারী সংগঠক বীর যোদ্ধা এমনকি খেতাবপ্রাপ্তদের যারা জীবিত তাদেরও এ তালিকা প্রণয়নে রাখা যায়। রাখা যায় গবেষকদের যদিও ৪৮ বছরে গোটা বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরোধী ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির পরবর্তী প্রজন্ম বৈবাহিকসূত্রে অনেকেই অনেকের আত্মীয় হয়ে গেছেন। তবু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্বার্থে তা প্রকাশিত হোক।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।