ভুয়া ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ গুলশানে আড়াই শ কোটি টাকার জমি দখল, আদালতের নির্দেশ অমান্য, মুক্তি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ঢাকা প্রতিনিধি,২৬ অক্টোবর : ভুয়া পাওয়ার অব  অ্যাটর্নির (আমমোক্তারনামা) জোরে রাজধানীর গুলশানে আড়াই শ কোটি টাকার সম্পদ দখল করে রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন মুন্নী ও তার স্বামী। আদালতে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ ভুয়া প্রমাণিত হলেও ওই জমি বুঝে নিতে পারছেন না ভুক্তভোগী ডা. এ এইচ মো. আলী হায়দার কোরেশী। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘মুক্তি ক্লিনিক’-এর ব্যানারে দখলকৃত ওই জমিটি আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে ভুক্তভোগীকে বুঝিয়ে দেওয়ার রায় দিয়েছেন ঢাকা প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের বিচারক উৎপল ভট্টাচার্য। ৭ অক্টোবরে ঘোষিত এ রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন মুন্নীর স্বামী ডা. আলী আসকার কোরেশী। তিনি বলছেন, টাকার বিনিময়ে রায় কিনেছেন বাদীপক্ষ। আর তাতে নেপথ্যে থেকে অনেক প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। একই সঙ্গে মুক্তি ক্লিনিকের নামে অসংখ্য অভিযোগও অস্বীকার করেছেন তিনি। মামলার নথিসূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯ বছর ধরে গুলশান-২-এর ৪৯ নম্বর সড়কের ২২ কাঠা (২ নম্বর বাড়ি) জমির ওপর অবকাঠামোতে ‘মুক্তি ক্লিনিক’ পরিচালনা করছেন ডা. আলী আসকার কোরেশী। একপর্যায়ে ১৯৯৮ সালের একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেখিয়ে জমির মালিকানা দাবি করে বসেন তার স্ত্রী বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী। তবে গত ৭ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের দেওয়া রায়ে এই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। রায়ে বলা হয়, নথিদৃষ্টে আরও দেখা যায় যে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নম্বর ৮১৩/৯৮ যেখানে শাহিন কোরেশী মিসেস ফাহিমা নাসরিন অর্থাৎ ২ নম্বর বিবাদীর স্ত্রীকে আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল তা যাচাই করার জন্য বাদীপক্ষ চিঠি দিলে বাদীবরাবর চিঠির মাধ্যমে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রথমে গত ৬/৮/২০১৩ তারিখের চিঠিতে, পরে ১৬/১/২০১৫ তারিখের চিঠিতে ওই আমমোক্তারনামা সঠিক ছিল না বলে উল্লেখ করেন। রায়ে আরও বলা হয়, হাইকমিশনের এই চিঠি দুটির বিষয়ে ২ নম্বর বিবাদী মৌখিক আপত্তি দেন। যেহেতু লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের পত্র দুটি স্বাক্ষর ও সিলযুক্ত, সেহেতু ওই পত্র দুটি অবিশ্বাসের আইনগত কোনো সুযোগ নেই। যা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়, বিবাদীপক্ষ তাদের দাবির সমর্থনে কাগজপত্র দাখিল না করে ১৯৯৯ সাল থেকে বিভিন্নভাবে মোকদ্দমাটিকে দীর্ঘায়িত করেন। রায়ের আদেশের অংশে বলা হয়, ‘মোকদ্দমাটি বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে দোতরফাসূত্রে বিনা খরচায় ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ ও বকেয়া ভাড়া আদায়ের ডিক্রি হইল। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বিবাদীপক্ষকে নালিশি তফসিল বর্ণিত সম্পত্তির দখল বাদীপক্ষ-বরাবর অর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইল। একই সঙ্গে বকেয়া ভাড়া ৭৫ লাখ ৬০ হাজার টাকাও বিবাদীপক্ষকে বাদী-বরাবর পরিশোধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইল।’ এ-সংক্রান্ত আরও কয়েকটি মামলার নথি ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে ডা. এ এইচ মো. আলী হায়দার কোরেশী স্ত্রী শাহিন কোরেশীর নামে গুলশানের ওই ২২.২ কাঠা জমি কেনেন। এরপর ১৯৭৫ সালে ডা. শাহিন কোরেশীর সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর জমির মালিকানা ফিরে পেতে ’৭৯ সালে ঢাকার যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে বেনামি সম্পত্তির মামলা করেন আলী হায়দার কোরেশী। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অষ্টম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের রায়ে জমিতে ষোলো আনা মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয় আলী হায়দার কোরেশীর। পরে ওই বছরই এ রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করে পক্ষে রায় পান তার সাবেক স্ত্রী শাহিন কোরেশী। ২০১৪ সালে জজ কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন (৩৮৫৩/২০১৪) আলী হায়দার। শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরীর একক হাই কোর্ট বেঞ্চ শাহিন কোরেশীর পক্ষে জজ কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের রায় বহাল রাখে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লন্ডনে মারা যান শাহিন কোরেশী। তবে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি সিভিল আপিল (২০৫/২০১৮) দায়ের করা হয়। যেখানে আবেদনকারী হিসেবে রয়েছে মৃত শাহিন কোরেশীর নাম। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ওই আপিল আবেদনটিও খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখে। গতকাল মুক্তি ক্লিনিকে গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে দখলকারী আলী আসকার কোরেশী বাড়িটির মালিক নন এমনটা স্বীকার করলেও আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘পয়সা দিয়ে এ রায় কেনা হয়েছে।’ সম্পদটির আমমোক্তারনামা দেখাতে পারবেন কিনাÑ জানতে চাইলে আলী আসকার কোরেশী বলেন, ‘আমি তো কাগজ নিয়ে বসে নেই। যেখানে দেখানোর সেখানে দেখানো হবে।’ ভুক্তভোগী আলী হায়দার কোরেশী এখন লন্ডনপ্রবাসী। তার ছোট ভাই আলী আসলাম কোরেশী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯৬৯ সালের দিকে গুলশানের এ জমিটা আলী হায়দার কোরেশী তার স্ত্রী শাহিন কোরেশীর (কনভার্টেড মুসলিম, আগের নাম ছিল কমলারানী রায়) নামে জমিটি কেনেন। ’৭০ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন চলে যান। তারপর তারা একটি ওষুধ কোম্পানিকে বাড়িটি ভাড়া দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহিন কোরেশীও লন্ডন গিয়ে স্বামীর সঙ্গে যোগ দেন। এরপর মামলা হলে ’৭৯ সালে আলী হায়দার জমিটির আমমোক্তারনামা আমাকে দেন।’ আলী আসলাম কোরেশী আরও বলেন, ‘১৯৭৯ সালে বাড়িটি যাতে কেউ বিক্রি করে দিতে না পারে সেজন্য আদালতে একটি মামলা করা হয়। আদালত ইনজাংশন জারি করে। ৪০ বছর ধরে সেই মামলা চলে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় বাড়ির মালিক আলী হায়দার কোরেশী। ১৯৯৩ সালে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয় মুক্তি ক্লিনিকের কাছে। তারা ছয় মাস ভাড়া দেয়। একসময় ভাড়া বন্ধ করে দিয়ে ফলস কাগজ তৈরি করে মালিকানা দাবি করে। আমরা তখন বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের মামলা করি। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা এখনো জমিটিতে আমাদের যেতে দিচ্ছে না। ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কোর্টের আদেশ আছে। ৩০ বছর ধরে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। দখল করে আছে। আলী আসকারের স্ত্রী এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের সব সময় হুমকির মুখে রেখেছেন। এখন তিনি ভদ্রভাবে চলে গেলেই হয়। কিন্তু তিনি যেতে চান না।’ এক প্রশ্নের জবাবে আলী আসলাম কোরেশী বলেন, ‘হুমকির বিষয়ে অনেক জিডি করা হয়েছে। বহুবার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জমিটির মালিকানা দাবিকারী অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোয় বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডাভিত্তিক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। সরকারের একপেশে সমালোচনায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাকে। এ ছাড়া গুলশানের ওই জমিতে স্থাপিত মুক্তি ক্লিনিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। মাদকাসক্তি নিরাময়ের জায়গায় চলছে মাদক ব্যবসা। চিকিৎসার নামে রোগীদের জিম্মি করে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা