১৬ আগস্ট হত্যাকারীদের তত্বাবধানে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দাফন

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,টুঙ্গিপাড়া প্রতিনিধি,১৬ আগস্ট : ১৯৭৫ এর ১৬ আগস্ট, রাজধানী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। নিজেদের রক্তাক্ত হাত ঢাকতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল হত্যাকারীরা।জাতির পিতার কফিন হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, ক্যাশিয়ার, পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার আনোয়র হোসেন, স্থানীয় মেম্বার আব্দুল হাই; এছাড়াও গ্রামবাসীদের আকবর কাজী, মোঃ ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সেনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক, গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ অন্যান্যরা।

বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীদের জীবিতদের একজন টুঙ্গিপাড়া পৌর সভার মেয়র মোঃ ইলিয়াস হোসেন বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে শুনেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। সেদিন টুঙ্গিপাড়ার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে টুঙ্গিপাড়া থানা সংলগ্ন হ্যালিপ্যাডে সেনা বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসা হয়। কফিন বহন করার জন্য আমিসহ অন্যান্যদের ডাকা হয়। আমরা হেলিকপ্টারের মধ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন বের করি। পরে বহন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসি।”বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক নিবাসে লাশ বহন করে আনার পর কফিন খুলতে ডাকা হয়েছিল ওই গ্রামেরই একজন কাঠমিস্ত্রীকে, যার নাম হালিম শেখ। সাথে সহযোগী হিসেবে ছিলেন মৃত হালিম শেখের ১০ বছর বয়সী ছেলে আয়ুব আলী শেখ যার বর্তমান বয়স ৫৩ বছর। মহান এই নেতার কফিন খুলবার ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে ধরা গলায় তিনি বলেন, “কফিন খোলার জন্য আমি ও আমার বাবা মরহুম হালিম শেখকে ডাকা হয়। আমি হাতুড়ি ও চেড়া শাবল দিয়ে কফিন খুলেই বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। গভীর শোকে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল আমার। তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন। মনে হচ্ছিল, সে কফিনে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিছু সময় আমি কাজের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ি। সেনা সদস্যরা দ্রুত কাজ করার ধমক দিলে আমার চেতনা ফিরে আসে। এ ঘটনার পর বেশ কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ গ্রহনকারীরা প্রায় সবাই মারা গেছে। আমি, ইদ্রিস কাজী, আনোয়ার হোসেন ও ইলিয়াস হোসেন এখন বেঁচে আছি।”ষড়যন্ত্রকারী ও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা স্থানীয়দের নির্দেশ দেন কফিনসহ দাফন করতে তবে ইমাম সাহেবের আপত্তি থাকায় তা সম্ভবপর হয়নি। মেয়র ইলিয়াস হোসেন জানান, “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনা সদস্যরা কফিনসহ লাশ কবর দেয়ার কথা বলে। মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধি বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। সেনা অফিসাররা (সব নিয়ম সেরে) ১৫ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের অনুমতি দেন।”বঙ্গবন্ধুর জানাজা ও লাশ দাফনের বিষয়ে মরহুম আব্দুল হালিমের সঙ্গে একজন মেজরের কথোপকথন ছিল এমন,মেজর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখানকার মৌলভী?” উত্তরে মরহুম আব্দুল হালিম বলেন, “জ্বি হ্যা।” এরপর তিনি আব্দুল হালিমকে লাশের জানাজার নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন। মেজর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কার জানাজার ব্যবস্থা করবো?” মেজর উত্তরে বললেন, “শেখ মুজিবের ডেড বডি।” তখন আমি ইংরেজীতে বললাম- “ইজ দ্য ডেড বডি অব শেখ মুজিব?” উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”উদ্দেশ্য ছিলো কফিন খুলবো। বঙ্গবন্ধুকে দেখবো তারপর মাটি দেব। কিন্তু মেজর সাহেব আমাকে বলেছিলেন কফিনসহই জানাজা পড়ে মাটি দিতে। যদিও আমি তা চাইছিলাম না। মেজর সাহেবকে আবার বললাম, “আই মাষ্ট সী দ্য ডেড বডি।” মেজর সাহেব বললেন, “ডু ইউ নট বিলিভ আস?” আমি বললাম, “আই বিলিভ ইউ, বাট ওয়ান্ট টু সি ফর মাই স্যাটিসফেকশন।”তারপর মেজর কফিনের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রথমেই দেখলাম মুখ রক্তাক্ত। কফিনের বাহিরে অবশ্য কোন রক্ত ছিলো না।তারপর মেজর সাহেবকে বলি, “ওনাকে তো গোসল দেয়া হয়নি। বিনা গোসলে কোন মুসলমানের জানাজা পড়া জায়েজ নয়।” মেজর জিজ্ঞাসা করেন, “বিনা গোসলে মুসলমানের জানাজা হয় না?” বললাম, “হয় কেবল মাত্র শহীদের লাশ বিনা গোসলে জানাজা করা হয়। তবে সম্ভব হলে তাও গোসল করানো উচিত।” মেজর তারপর লাশের গোসলের নির্দেশ দিলেন। সময় দিলেন ২ মিনিট। আমি পুনরায় বললাম, “গোসল করাতে আমার কজন লোক লাগবে।” তিনি আমাকে বললেন, “সর্বাধিক ৮ জন নিতে পারেন।”এরপর খোলা হয়েছিল কফিনটি। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর সেই রক্তমাখা অবয়বের বর্ণনাও দিলেন তিনি, “বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়েছিল। গুলি গুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর হাতেও গুলি লেগেছিল। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিলো সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবী। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবীর এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ।”ইলিয়াস হোসেন জানান, “যে তর্জনীর ইশারায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে ঢেউ তুলেছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট কলোরাতে ঘাতকরা তাকে হত্যা করে তর্জণী কেটে দেয়।”কফিন থেকে জাতির পিতার লাশ বের করার পরে তাকে গোসলের জন্য নেয়া হয়। স্থানীয় আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে কিনে আনা ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী গোসল করানো হয়েছিল বলে জানান তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে শেষ গোসল করিয়েছিলেন মন্নাফ শেখ, সোনা মিয়া ও ইমান উদ্দিন গাজী।শেষ নিঃশ্বাস অবধি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে আসা এই মহানায়কের পোশাক ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। সাদা সূতী পাঞ্জাবী-পাজামা আর কালো কোট ছিল তার চিরচেনা রূপ। আর শেষ বিদায়ে কাফনের কাপড়টি যেন আরও সহজিয়া, আরও অনাড়ম্বর! রেডক্রিসেন্টের ত্রাণের যে শাড়ী এসেছিল দুঃস্থদের জন্য, তার দেশের অসহায় মানুষের জন্য; সে কাপড় দিয়েই কাফন পরানো হয়েছিল তাকে। এপ্রসঙ্গে ইলিয়াস হোসেন বলেন, “রেডক্রিসেন্ট এর মালা শাড়ী আনা হয়েছিল। সে শাড়ীর জমিনে সাদা আর পাড়ে লাল-কালো ছিল। সেই পাড় ছিঁড়ে ফেলে বঙ্গবন্ধুর কাফন হিসেবে পরানো হয়েছিল।”হত্যাকান্ডের দ্রুত সমাধী করতে সামরিক সেই সেনা কর্মকর্তারা জনসাধারণকে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। দাফনক্রিয়ায় টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতী ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের মাত্র ৩০/৩৫ জন অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনকারী অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনে গ্রামের মানুষ অংশ নিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পথেই পুলিশ ও সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেয়। তারা দাফনে অংশ নিতে পারেনি।”জানাযা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জানাযা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম। জাতির পিতার লাশ দাফন শেষে সেনা সদস্যরা ডাইরিতে শেখ আব্দুল মান্নাফের স্বাক্ষর গ্রহণ করে চলে যান। তবে কবর দেওয়ার পরেও সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কবরের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না। টুঙ্গিপাড়াবাসী বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ ও কুরআন খানি আয়োজন করেছিল।টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল বশার খায়ের বলেন, “ওই দিন আমি বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ নিতে টুঙ্গিপাড়া আসতে গেলে পথেই আমাকে আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকজন আটকে দেন। দাফনের পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত বা শ্রদ্ধা নিবেদন নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে গিয়ে অনেকেই পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছে। তারপরও পুলিশের বাঁধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু অনুরাগীরা কবরে এসে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে লাশ টুঙ্গিপাড়া গ্রামে দাফন করে ওরা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।”