বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও আন্দোলনসহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ইস্যুতে আপাতত দলের সিনিয়র নেতাদের চুপচাপ থাকতে বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। গত কয়েকদিনে দলের স্থায়ী কমিটির পাঁচজন সদস্যসহ বেশ কজন সিনিয়র নেতা দেখা করতে গেলে তাদের সবাইকে একই পরামর্শ দেন তিনি। বললেন, মন্ত্রী-এমপি কিংবা সরকারি দলের নেতারা যত উগ্র কথাবার্তা কিংবা যে যা-ই বলুক না কেন— তাদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। এর পাশাপাশি দলীয় ঘরানার কয়েকজন বুদ্ধিজীবীও সাক্ষাৎ করেছেন তাঁর সঙ্গে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার জবাবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলা এগুলো। এটা দেশি-বিদেশি সবাই জানেন। বিএনপি ও আমাকে চাপে রাখার জন্যই এসব করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্যকে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ভোট মানেই হলো— ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ। এখন ভোটাররাই যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারেন, তারা যদি তাদের ভোটই দিতে না পারেন— তাহলে সেটি নির্বাচন হলো কী করে? এ জন্য প্রকৃত অর্থে— জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাদেরকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। আর তার জন্য দরকার নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় নির্বাচন। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে অবশ্যই বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে। কারণ এই সংসদের বেশিরভাগ সদস্যই বিনাভোটে নির্বাচিত। প্রধান বিচারপতি এই সংসদকে অকার্যকর বলে অভিহিত করেছেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণে। যা এখনো বহাল রয়েছে। অতঃপর আগামী জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ একটি সরকার ব্যবস্থার অধীনেই হতে হবে। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও বেগম খালেদা জিয়া একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। গত রবিবার মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশেও বেগম খালেদা জিয়া একই অবস্থান ব্যক্ত করে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, আন্দোলন এবং নির্বাচন দুটোর জন্যই একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে। আগামী দিনে আমরা কর্মসূচি দেব। সেই কর্মসূচি পালন এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ— দুটোর জন্যই সবাইকে একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনারা প্রস্তুতি নিন। তার আগে শনিবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ২০১৮ সাল হবে গণতন্ত্রের বছর। নতুন বছর মানুষের স্বস্তি ও শান্তির বছর হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অপর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত নানা ধরনের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যাওয়া শুরু হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে। এসব ব্যাপারে তিনি নিজেও অনেকটা চুপচাপ নীতি পালন করছেন। তবে সবকিছুই তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানা গেছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি দলের নেতাদের সাম্প্রতিক নানা উসকানিমূলক বক্তব্যের জবাবে বিএনপি নেতাদের চুপচাপ থাকার এই নির্দেশ দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের ‘টপ টু বটম’ কমবেশি সবাই এ ধরনের উসকানি দিয়ে বক্তব্য রাখছেন। কেউ বলছেন— বিএনপি নাকি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে যাবে। আবার কেউ বলছেন, বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচনেও যাবে, আবার ফলাফলও মেনে নিতে বাধ্য হবে। তবে সেরকম উপযোগী পরিবেশ-পরিস্থিতি হলে বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেবে এবং জনগণ যে রায় দেবে সেটি মেনে নেবে। কারণ দেশের সবচেয়ে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল হলো— বিএনপি। কিন্তু সে জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর তা আন্দোলন করে হলেও তৈরি করতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু সরকারের কোনো উসকানি কিংবা ফাঁদে পা দিয়ে কিছুই করা যাবে না। জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও একই নির্দেশনা দিয়ে বিএনপি প্রধান বলেছিলেন, কথা বলতে হলে সবাইকে একই সুরে একই ধরনের কথাবার্তা বলতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ধরনের বেফাঁস কথাবার্তা বলা যাবে না। কিন্তু অতি সম্প্রতি রংপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা একেক ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। যা দলের ভিতরে ও বাইরে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের পাতানো ফাঁদে যেমন পা দেওয়া যাবে না, তেমনি তাদের উসকানিমূলক বক্তব্যেও সাড়া দেওয়া যাবে না। কারণ এ সরকার স্বেচ্ছাচারিতার চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশে এখন একটা চরম বৈরী অবস্থা চলছে। সুতরাং এ অবস্থায় যতটুকু চুপচাপ থাকা যায় ততই মঙ্গল। তবে ‘দেশনেত্রী’ বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী— আগামী দিনের আন্দোলন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটোর জন্যই সবাইকে একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে। দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে যাবে। তবে তার আগে একটা নিরপেক্ষ অবস্থা তৈরি করতে হবে। ‘লেভেল প্লেয়িং’ ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এ জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে আর কোনো ধরনের পাতানো নির্বাচন হতে দেবে না জনগণ।
এ বিষয়ে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, বেফাঁস কথাবার্তা বলার চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো। এতে কাজও বেশি করা যায়। বিতর্কও কম হয়। বেশি কথা বললে বরং মানুষ বিরক্ত হয়।