কাকন বিবিঃ বীরাঙ্গনা, গুপ্তচর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিশেষে ভিখারিনী…

SHARE

ratan-kumer-majumder_84373কাকন বিবিঃ বীরাঙ্গনা, গুপ্তচর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিশেষে ভিখারিনী

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা কত জন? সবাই জানে দুই জন। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম,তারামন বিবি । আরো একজন আছে। কাকন বিবির নাম শুনেছেন কি? তিনি খাঁসিয়া সম্প্রদায়ের বীরাঙ্গনা, গুপ্তচর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান বয়স ৮৫’র আশে পাশে। অন্তত ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করেছিলেন। পড়ুন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন পেজে যা লেখা আছে তাঁর সম্বন্ধেঃ

১৯৭১-এর এই যোদ্ধা স্বাধীনতার পর লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ অন্তরালে ছিলেন বহুদিন। ১৯৯৬ সালে সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু তাকে ভিক্ষারত অবস্থায় আবিষ্কার করেন।কাকন বিবির বীরত্বের কথা যখন সবার নজরে আসে তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই সাথে ঘোষণা দেন কাকন বিবিকে বীরপ্রতীকে ভূষিত করার। কিন্তু পরবর্তীতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যা গেজেটেড আকারে প্রকাশিত হতে হতেই আবার সবাই ভুলে বসেন এই নারীর কথা। কিন্তু এখনো অনেক রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে কাকন বিবিকে বীরপ্রতীক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যা টেকনিক্যালী ভুল।

আসুন জেনে নিই একাত্তরের এই বীরাঙ্গনার কিছু কথা। আপনারা বোধহয় অনেকে মাতাহারীর কথা জানেন।ইতিহাসে সবচেয়ে সুপরিচিত নারী গুপ্তচর বা স্পাই। জার্মানির পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ফ্রান্স ১৯১৭ সালে তাকে পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু একাত্তরে কাকন বিবির পুরো নয়মাসে বীরত্বের কথা শুনলে বুঝতে পারবেন ইতিহাসের অন্যান্য গুপ্তচররা তার তুলনায় কিছুই নয়।

ইপিআরের সৈনিক মজিদ খানকে বিয়ে করে কাকন বিবির নাম হয় নূরজাহান। একাত্তরে যখন দোয়ারিবাজার সীমান্তে পাকবাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে তখন কাকন বিবিকে আটক করে পাকিস্তানী সৈন্যরা।আটক করে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। দিন রাত তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে পাক বাহিনী এবং তার দোসররা। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠতে থাকেন এই বীরাঙ্গনা। তার ভেতরে জন্ম নেয় প্রতিশোধের আগুন। পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা তাকে ছেড়ে দিলে তার দেখা হয় মুক্তিযোদ্ধা রহমতের সাথে। রহমত তাকে নিয়ে আসেন সেক্টর কমান্ডার মীর শওকাত আলীর কাছে। শওকাত আলী তাকে গুপ্তচরবৃত্তির নির্দেশ দেন।

শুরু হয় কাকন বিবির জীবনের নতুন অধ্যায়।কখনো পাগল,কখনো ভবঘুরে ইত্যাদি বেশে তিনি পাকবাহিনীর গতিবিধি নিয়মিত পৌঁছে দিতেন মুক্তিবাহিনীর কাছে। তার এসব তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অপারেশন সফলভাবে পরিচালনা করে। কিন্তু বিধি বাম।

একদিন গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়ে বাংলাবাজারে তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। শুরু হয় তার উপর আবার নির্যাতন। তারা তাঁকে একনাগাড়ে ৭ দিন বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ১২/১৩টি ছাঁকা দেয়। যা আজো কাকন বিবিকে নাড়া দেয় । পরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় মৃত ভেবে পাঞ্জাবিরা ফেলে রেখে যায়। সাতদিন পর তার জ্ঞান ফিরে এলে মুমূর্ষ অবস্থায় তাঁকে চিকিৎসা করানো হয়।

যারা ভাবছেন এখানেই তার বীরত্বের সমাপ্তি তারা কিন্তু ভুল করছেন। কারণ চিকিৎসা শেষে কাকন বিবি আবার দেশে ফিরে আসেন।এবার প্রতিশোধের নেশায় আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং পাকবাহিনী বধের জন্য তার লক্ষ্য অবিচল। এবার তিনি প্রশিক্ষণ নেন অস্ত্র চালনার। শুরু হয় পাকবাহিনীর সাথে তার সশস্ত্র সংগ্রাম।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন। সেই যুদ্ধে কয়েকটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। উড়ুতে সেইসব গুলির ক্ষত তার এখনও আছে।সুস্থ হলে আবারো অস্ত্র হাতে তিনি যুদ্ধে নামেন। মুক্তিবাহিনীর সাথে একে একে অংশগ্রহণ করেন আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বলিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূর্বিনটিলা, আধারটিলা সহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে তিনি অস্ত্র সহকারে যুদ্ধ করেন। এখানে উল্লেখ্য,আমবাড়ির যুদ্ধে আবারো তার পায়ে গুলি লাগে। দুই দুই বার তিনি যুদ্ধে আহত হন।আরা হানাদারদের কাছ থেকে সহ্য করা নির্যাতনতো রয়েছেই। এভাবেই তিনি দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখেন।

কিন্তু পাকিস্তানীদের পরাজয় করতে পারলেও দারিদ্র্যকে পরাজিত করতে পারেন নি এই দুঃসাহসী বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের পর থেকেই তিনি অর্ধাহারে,অনাহারে দিন কাটাতে থাকেন।

রতন কুমার মজুমদার’র স্ট্যাটাস থেকে