ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,স্বাস্থ্য প্রতিনিধি,১৯ জুন : সারাদেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে জনবল সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রায় একযুগ আগে থেকে ধাপে ধাপে সব হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ৩০ হাজার পদ শূন্য থাকলেও তাতে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও জনগণের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে বাড়িয়ে ৮শ’ থেকে দুই হাজার ৬০০-তে উন্নীত করা হয়েছে। শয্যা সংখ্যা ১১শ’ করার সময় জনবল নিয়োগ করা হয়েছিল। এরপর গত একযুগে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও নতুন জনবল নিয়োগ হয়নি। ১১শ’ শয্যার জনবল দিয়েই হাসপাতালটি চালানো হচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে গুরুতরভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘স্পেশাল’ কর্মচারী নিয়োগ করে কর্তৃপক্ষ কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। অবৈতনিক এসব ‘স্পেশাল’ কর্মচারীর রোগীর কাছ থেকে পাওয়া ‘বকশিশ’ উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। অভিযোগ রয়েছে, বকশিশের টাকা নিয়ে রোগীর স্বজনের সঙ্গে প্রায়ই তাদের দ্বন্দ্ব হয়। এ ছাড়া ট্রলি, শয্যাসহ বিভিন্ন কারণে রোগীদের টাকা দিতে হয়। তবুও কর্তৃপক্ষ অসহায়; তাদের এসব ‘স্পেশাল’ কর্মচারীদের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, স্থায়ী পদের বাইরে কোর্সে ভর্তি হওয়া চিকিৎসক, ইন্টার্ন, অবৈতনিক চিকিৎসকদের নিয়ে রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত বছর নার্স নিয়োগের ফলে সংকট কিছুটা দূর হয়েছে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট সংকট এখনও রয়েছে। তবে নন-মেডিকেল পদ নিরাপত্তাকর্মী, আয়া, পরিচ্ছন্নকর্মীসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকটের কারণে রোগীর সেবা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ১১শ’ শয্যার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী যে পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখানেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫৬০টি পদ শূন্য আছে। ঢামেক পরিচালক মনে করেন, রোগীর সেবার মান বাড়াতে শয্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনবল বাড়ানো প্রয়োজন।
জানা যায়, উচ্চ আদালতের আদেশে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধন বাতিল হওয়ার কারণেই স্বাস্থ্য খাতে নতুন করে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া আটকে গেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধন বাতিল হওয়ার পরও ১৬৬টি অধ্যাদেশকে সংরক্ষণ করে ওই সময়ে জারি করা বিধিমালাগুলোকে ২০১৩ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ওই আইনে কেন অন্তর্ভুক্ত হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার চাইলে ১৬৬টির সঙ্গে আরেকটি অধ্যাদেশ সংরক্ষণ করে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত জনবল নিয়োগ করতে পারে। অন্যথায় আগামী পাঁচ বছরেও স্বাস্থ্য খাতে জনবল নিয়োগ করা যাবে না।
জনবল সংকটের চিত্র: দেশের ৩০ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ৬৪ জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টস, ফার্মাসিস্টের পাশাপাশি ওয়ার্ড বয়, ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী, আয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল সংকট গুরুতর আকার ধারণ করেছে। পরিচ্ছন্নকর্মী সংকটের কারণে হাসপাতালগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০ হাজার ৩৮৩টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ৮ হাজার ৫৯টি নন-মেডিকেল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে ৫৬০টি, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৩৫টি, সোহরাওয়ার্দী, হৃদরোগ, ক্যান্সার হাসপাতালে ১০০টি করে, বক্ষব্যাধি, কিডনি, মানসিক ও ইএনটি হাসপাতালে ৫০টি করে, চক্ষুবিজ্ঞান, নিউরো সায়েন্সে ৩০টি করে পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া অন্য হাসপাতালগুলোতে ২০ থেকে ২০০ পর্যন্ত পদ শূন্য আছে। হাসপাতালগুলোয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট ও টেকনিশিয়ানের পদ শূন্য আছে প্রায় ৫ হাজার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমান মেয়াদে একযোগে সাড়ে ৬ হাজার চিকিৎসক এবং প্রায় ১০ হাজার নার্স নিয়োগ করে তাদের গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পদায়ন করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। শুধু চিকিৎসক ও নার্সের ওপরই স্বাস্থ্যসেবা নির্ভরশীল নয়। এর সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও যুক্ত রয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে দেশের সব হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলের চরম সংকট রয়েছে। এ কারণে জনগণের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দ্রুত এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে।
যে কারণে জনবল নিয়োগ করা যাচ্ছে না: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’- এর আওতায় নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ এবং সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬ বাতিল হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারিকৃত নিয়োগ বিধিমালা বা অন্যান্য বিধিমালা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে ১৬৬টি অধ্যাদেশকে সংরক্ষণপূর্বক ওই সময়কালীন জারিকৃত বিধিমালাগুলোকে ২০১৩ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ওই ১৬৬টি অধ্যাদেশের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ণিত নিয়োগ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। প্রায় দেড় বছর আগে পদোন্নতি বা নিয়োগ কার্যক্রম বৈধ নিয়োগবিধির আওতায় আনার অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর এবং ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকের পর গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে জানানো হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিদ্যমান নিয়োগবিধি ‘স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’ সংশোধন ছাড়া সরাসরি নিয়োগযোগ্য শূন্য পদ পূরণের বিধিগত কোনো বাধা নেই। তবে চিঠিতে এ সংক্রান্ত বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ১৯ আগস্ট এক চিঠিতে জানানো হয়, ২০১৩ সালের বর্ণিত আইন (৩)-এর আলোকে নিয়োগ বিধিমালা সংরক্ষিত না হওয়ায় বিধিটির বৈধতা নেই। এ অবস্থায় ওই বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ কিংবা নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম গ্রহণের সুযোগ নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের এ মতামতের পরই স্বাস্থ্য খাতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে যায়।
চলতি মাসের ৬ তারিখ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্বাস্থ্য খাতের জনবল সংকটের চিত্র তুলে ধরেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী দ্রুত জনবল নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। জনবল সংকট ও এ কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে তারা প্রধানমন্ত্রীকে একটি সারসংক্ষেপ দেন।
আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ চায় মন্ত্রণালয়: আইনি জটিলতায় সম্ভব না হলে আপাতত আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দিতে চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া সারসংক্ষেপে বলা হয়, নিয়োগ বিধি প্রণয়ন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া জরুরি। নতুন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য ‘স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৬’-এর খসড়া প্রণয়ন করে গত বছরের ৬ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, বিধিমালা জটিলতার কারণে জনবল নিয়োগ দেওয়া না গেলে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করা হলে আপাতত সংকট কিছুটা দূর করা যাবে। নতুন নিয়োগ বিধি প্রণয়নের পর ওই জনবলের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়েজ আহমদ বলেন, যেভাবেই হোক হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে জনবল প্রয়োজন। সে জন্য আইনি জটিলতার কারণে স্থায়ী নিয়োগ সম্ভব না হলেও আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।